‘এ যে ময়দানবের দুর্গ!’ অবাক হয়ে বললেন চক্রবর্তী।
‘মেহেরা দানবের দুর্গ।’ হেসে বললেন যুধাজিৎ সেন, ‘তবে এ-দুর্গকে হার মানিয়েছে প্রশান্ত সরখেল। আমার অনুমান, অন্য সব অতিথিদের সঙ্গে সে ভল্টে ঢোকে, এবং মিসেস মেহেরার অলক্ষ্যে সিন্দুকের পেছনে লুকিয়ে থাকে। অন্যান্য অতিথিরা ভল্ট ছেড়ে বেরিয়ে যান। সব শেষে যান মিসেস মেহেরা। নেকলেসটা সিন্দুকে বন্ধ করে বিপদঘণ্টি চালু করে তিনি বাইরে থেকে ভল্টের দরজা বন্ধ করে দেন। আমরা জানি প্রশান্ত সরখেল পাকা সিন্দুকবাজ। সুতরাং, সিন্দুক খুলে নেকলেস হাতানো তার কাছে নিতান্তই ছেলেখেলা। কিন্তু ওই বন্ধ ভল্ট থেকে বিপদঘণ্টি না-বাজিয়ে সে বেরোল কেমন করে?’
যুধাজিৎ সেন সিগারেটের শেষ টুকরোটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। পাঁচশো পঞ্চান্নর প্যাকেটটা রাখলেন পকেটে। তারপর টেবিলে রাখা সানগ্লাসটার গায়ে আঁচড় কাটতে লাগলেন। সানগ্লাসের দিকে নজর স্থির রেখেই তিনি বললেন, ‘কেমন করে সরখেল বেরোল সে-কথা জানার জন্যে আমি মিসেস মেহেরাকে বললাম আমাকে সেই ভল্টে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিতে।’ শান্ত স্বরে কথা শেষ করলেন যুধাজিৎ সেন।
‘সাবাস!’ বললেন ডি. সি., ‘তোমার তুলনা নেই, সেন। কিন্তু তুমি বেরোলে কেমন করে?’
যুধাজিৎ সেন চোখ তুলে তাকালেন। মুখে ধূর্ত হাসি। বললেন, ‘ভেবেই দেখুন না।’
‘দরজা ড্রিল দিয়ে ফুটো করে?’ সমীর চক্রবর্তী প্রশ্ন করলেন।
‘উঁহু। মনে রাখবেন, সরখেল ঠিক যে-কায়দায় ওই ঘর থেকে বেরিয়েছে আমাকেও ওই একই কায়দায় বেরোতে হয়েছে। আর, একটা গোটা ড্রিল সঙ্গে করে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া ওর পক্ষে কোনও মতেই সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া ভল্টের মধ্যে কোনওরকম খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন আমার নজরে পড়েনি।’
‘তা হলে নিশ্চয়ই বাইরে থেকে কেউ তোমাকে বেরোতে হেল্প করেছে।’ সমীর চক্রবর্তী তাঁর দ্বিতীয় অনুমান উচ্চারণ করলেন।
‘না।’
‘ফলস দেওয়াল?’
‘উঁহু—।’
‘লুকোনো দরজা?’
‘তাও নয়।’
‘দে বইটা দে।’ হঠাৎ পেছন থেকে মোহনের গলা শুনতে পেলাম—শুনে চমকে উঠলাম।
‘দাঁড়া, আর-একটু—।’
কিন্তু তার আগেই মোহন লোমশ হাত বাড়িয়ে বইটা ছিনিয়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে।
‘যা, কাট। বললাম শালা বইগুলো লাট হয়ে যাবে, তাও—।’
‘এই, মোহন—প্লিজ। শুধু ওই গল্পটা শেষ করতে দে।’
‘হ্যাঁ, শেষ করতে দিই, আর পাতা উলটে দেখবি গল্পটার শেষে ”ক্রমশ” লেখা আছে। ব্যস, তখন যে ক’মাস ওই গল্পটা শেষ না-হবে, সে ক’মাস তুমি আমাকে জ্বালাতে আসবে।’
ভগবানকে ডাকলাম, যেন মোহনের ধারণা ভুল হয়। ‘বন্ধ ঘরের রহস্য’ যেন এই সংখ্যাতেই শেষ হয়। কিন্তু অতীতে মাসিক ‘ক্রিমিনাল’ যে এরকম করেনি তা নয়। যুধাজিৎ সেন ও সমীর চক্রবর্তীকে মাসের পর মাস একই কাহিনি নিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তাঁদের খাওয়া নেই দাওয়া নেই, শুধু সিগারেটের পর সিগারেট উড়িয়ে মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত টেবিলে বসে একটাই রহস্যের সমাধান করে গেছেন। জানি না, অনেক পাঠক হয়তো এই মাসিক উৎকণ্ঠা পছন্দ করেন, কিন্তু আমি করি না। আমি ঝাড়াঝাপটা রহস্য পছন্দ করি। গল্পের রহস্যের কায়দা ও চালাকি মেশানো সমাধান আমার মোটেই ভালো লাগে না।
কিন্তু সে-কথা মোহনকে বোঝানোর প্রয়োজন দেখলাম না। শুধু বললাম, ‘শোন, মোহন, ওই গল্পটা যদি এই সংখ্যাতেই শেষ হয়ে থাকে তা হলে ম্যাগাজিনটা আমি কিনব।’
‘কিনবি? তুই?’ ওর চোখ-মুখে হালকা বিস্ময়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ছ’টা পনেরো।
‘বল। রাজি?’ অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম।
‘ঠিক আছে।’ নিমরাজি হয়ে মোহন বলল, ‘তবে আমি দেখব গল্পটার শেষ আছে কি না। তোর কথায় আমি বিশ্বাস করি না।’
অপমানটা গায়ে না-মেখে বললাম, ‘আয়, দুজনে মিলেই দেখি।’
দেখলাম।
দুজনে একসঙ্গে ঝুঁকে পড়ে পাতা উলটে চললাম।
দু-পাতা পরেই গল্পটা শেষ হয়েছে। (যুধাজিৎ সেনকে তা হলে বেশি কষ্ট করতে হয়নি)। দেখলাম, গল্পের নীচে লম্বা ড্যাশ—অর্থাৎ গল্প শেষ। একইসঙ্গে শেষ দুটো লাইনে চোখ বুলিয়ে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
‘ও, তা হলে এই ব্যাপার,’ বললেন সমীর চক্রবর্তী, ‘সাবাস, সেন! তোমার জবাব নেই!’
মোহন ডানহাতটা আমার দিকে এগিয়ে দিল—দামের জন্যে।
‘এই নে—’পকেট থেকে পুরোপুরি তিনটে টাকা বের করে ওর হাতে দিলাম। বললাম, ‘কমিশন চাই না। বাড়তি পয়সাটা তোর বই লাট করার ফাইন হিসেবে রেখে দে।’
দেওয়াল ঘড়িতে ছ’টা সতেরো।
‘আজকের দিনটা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে।’ হেসে বলল মোহন, ‘কারণ, তুই পুরো দাম দিয়ে আমার দোকান থেকে ম্যাগাজিন কিনেছিস।’
আমি চট করে ম্যাগাজিনটা ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে গেলাম। কিন্তু ও আরও তৎপর। ঝটিতি ওটা লুকিয়ে ফেলল পেছনে। হাসল দাঁত বের করে—অনেকটা বাঁদরের মতো। ডারউইন হাজির থাকলে এই মুহূর্তে মোহন সরকারকে মিসিং লিংক ভেবে তুলে নিয়ে যেতেন।
‘ম্যাগাজিনটা তোর ভীষণ দরকার, নারে?’
‘জানিস তো রহস্য গল্প আমার ভালো লাগে?’
‘তাই নাকি? দেখি তো এই ”বন্ধ ঘরের রহস্য”-তে কী এমন আছে। তোর ইন্টারেস্ট দেখে মনে হচ্ছে এ-গল্পের নায়ক নির্ঘাত ছুঁড়ি নিয়ে ফষ্টিনষ্টি শুরু করে দিয়েছে।’
‘নারে।’ ওকে বললাম, ‘বিষ্ময়কর প্রতিভা যুধাজিৎ সেন শুধু রহস্যই ভালোবাসে, অন্য কিছু নয়।’