‘বলছি।’ সুবিখ্যাত গোয়েন্দাপ্রবরের চোখে ঝিলিক মারল খুশি। পকেট থেকে পাঁচশো পঞ্চান্নর একটা প্যাকেট বের করে টেবিলে রাখলেন তিনি। আনুষ্ঠানিকভাবে একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘কেসটা বড় অদ্ভুত, আর একইসঙ্গে বড্ড কমপ্লিকেটেড’। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, কী বিচিত্র ঘটনাচক্রেই না চোরকে আমি গ্রেপ্তার করেছি। তখন আমি জানিই না মেহেরাদের নেকলেস চুরি গেছে। গতকাল রাত দশটা নাগাদ আমি বাড়িতেই ছিলাম। সোফায় আরাম করে বসে একটা ডিটেকটিভ বই পড়ছিলাম। হঠাৎই শুনতে পেলাম দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি বেঁটেখাটো রোগা চেহারার একজন যুবক সেখানে দাঁড়িয়ে। প্রথমে সে বিরক্ত করার জন্যে কাঁচুমাচু হয়ে ক্ষমা চাইল, তারপর জানাল যে, তার গাড়িটা আমার বাড়ির সামনে হঠাৎই বিগড়ে গেছে। কাছাকাছি কোনও মোটর গ্যারেজ নেই। আর এত রাতে লোকজনের সাহায্য পাওয়াও মুশকিল। সুতরাং আমি যদি আমার ফোনটা ব্যবহারের অনুমতি দিই তা হলে সে বাড়িতে ফোন করে একটা খবর দিতে পারে।
‘প্রথমটায় আমি তাকে ঠিক চিনে উঠতে পারিনি, কিন্তু তার অতিরিক্ত শৌখিন ভদ্র ব্যবহার আমার মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলল। ফোন করা হয়ে গেলে আমি তাকে এগিয়ে দিলাম গাড়ি পর্যন্ত। আর তখনই মেহেরার নেকলেসটা আমার নজরে পড়ল—ওটা গাড়ির পেছনের সিটে নিরীহভাবে পড়ে ছিল। তখন নেকলেসটার ঠিকুজি-কুষ্ঠি না-জানলেও এটুকু বুঝেছিলাম, ওটার দাম কম করেও আকাশছোঁয়া। সুতরাং লোকটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে চেপে ধরলাম এবং খুব সহজেই সে সবকিছু স্বীকার করে বসল। তার নাম প্রশান্ত সরখেল। অসমসাহসী এবং বুদ্ধিমান সিন্দুক-ভাঙিয়ে হিসেবে নীচু মহলে তার নাম-ডাক আছে। গত কয়েকবছরে গোটা ভারত জুড়ে যেসব ”আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব” চুরি-ডাকাতি হয়েছে, সেসব তারই কীর্তি। তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সমস্ত রাজ্যের পুলিশ।’
‘একেই বলে ঘটনাচক্র!’ সিগারেটটা টেবিলের ওপরে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে ডি. সি. বললেন, ‘তোমার তারিফ করতে হয়।’
দারুণ, মনে-মনে বলে উঠলাম। তারপর পাতা ওলটালাম।
যুধাজিৎ সেন সামান্য হেসে মাথা ঝোঁকালেন। তারপর আবার শুরু করলেন, ‘ঘটনাচক্রই বটে। তবে আমার কৌতূহল হচ্ছিল কী করে সরখেল এই অসম্ভব কাজ হাসিল করল। সুতরাং সরখেলের কাছ থেকে মেহেরা ম্যানসনের ঠিকানা নিলাম। নেকসেটা রাখলাম নিজের হেফাজতে। আর ওকে হাত-পা বেঁধে বন্দি করে রাখলাম বাড়িতে। তারপর রওনা হলাম সাদার্ন অ্যাভিনিউর দিকে।
‘রাত তখন এগারোটা। কিন্তু মেহেরা ম্যানসন আলোকসজ্জা আর মণ্ডপসজ্জায় ঝলমল। শুনলাম, মিসেস মেহেরার ছোট ছেলের আজ জন্মদিন। তাই এই উৎসব। বাড়ি অতিথি-অভ্যাগতে ভরপুর। চারপাশে রঙচঙে ব্যস্ত মানুষজনের আনাগোনা। আমি একজন সুন্দরী তরুণীর পথ আটকে জানতে চাইলাম মিস্টার মেহেরাকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে। বিশেষ দরকার। তরুণীটি জানাল, মিস্টার মেহেরা দোতলায় তাঁর স্ত্রী ও ছেলের কাছে আছেন।
‘সুতরাং দোতলায় উঠলাম। কেউই আমাকে বাধা দিল না। উৎসব বাড়িতে কে-ই-বা কার খবর রাখে! যেমনটা হয়েছিল প্রশান্ত সরখেলের বেলায়। দোতলায় পৌঁছে খোঁজাখুঁজি করতে হল না। দেখলাম একটা ঘরের দরজায় নিওন সাইনে লেখা ‘হ্যাপি বার্থডে’ এবং সেই ফুলে আলোয় সাজানো ঘর থেকে পাঁচমিশেলি হইহুল্লোড় ভেসে আসছে। সুতরাং সেই ঘরে ঢুকে পড়লাম।
‘বাচ্চা-মেহেরাকে সাজিয়েগুজিয়ে একটা সুন্দর খাটে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাকে ঘিরে আত্মীয়-পরিজন অতিথিদের সমাবেশ। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই গুঞ্জন নীচু পরদায় নেমে এল। সকলেরই চোখে সপ্রশ্ন দৃষ্টি। আমি নীরবে পকেট থেকে আইডেনটিটি কার্ডটা বের করে তুলে ধরলাম। গম্ভীর গলায় বললাম, অ্যাটেনশান প্লিজ, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন। মিস্টার মেহেরা কোথায়?
‘আমার প্রশ্নে বাচ্চাটার পাশ থেকে বছর চল্লিশের জনৈক ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। চোখে চশমা, পুরুষ্টু গোঁফ। আমার সামনে এসে থামলেন তিনি: ইয়েস?
‘আপনার স্ত্রীর একটা দামি নেকলেস চুরি গেছে।’ শান্ত স্বরে বললাম।
‘এ-খবরে সব্বাই নির্ঘাত চমকে গেছে।’ টেবিলে টোকা মারতে-মারতে ডি. সি. চক্রবর্তী বললেন।
‘সে আর বলতে!’ সিগারেটে এক সুদীর্ঘ টান দিয়ে যুধাজিৎ সেন বললেন, ‘নেকলেসটা যে ফিরে পাওয়া গেছে সে-কথা বলে ওঠবার আগেই একজন সুন্দরী মহিলা অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লেন ঘরের মাঝখানে। সম্ভবত মিসেস মেহেরা। তারপর জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল, ঘণ্টাদুয়েক আগে নেকলেসটা সবাইকে দেখিয়ে মিসেস মেহেরা একতলার ভল্টে রেখে আসেন। এবং সেই ভল্ট পরিদর্শনের জন্যে তিনি অতিথিদের আহ্বান জানান। সঙ্গে-সঙ্গেই আমি অনুমান করলাম, সরখেলও নিমন্ত্রিতদের ছদ্মবেশে সেই ভল্টে সকলের সঙ্গে ঢুকেছিল। অবশ্য এটা নেহাতই সহজ কাজ।’
তারপর কী হল? মনে-মনে প্রশ্ন করে পাতা ওলটালাম।
যুধাজিৎ সেনের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে উৎসুক চোখে তাকালেন ডি.সি.।
লালবাজারের তীক্ষ্নধী অফিসার বলে চললেন, ‘ভল্টের ভেতর একটা সিন্দুকে ছিল নেকলেসটা। তার সঙ্গে অন্যান্য গয়নাও ছিল। ভল্টের একটাই মাত্র দরজা—কোনও জানলা নেই। সেই দরজার চাবি সবসময়েই থাকে মিসেস মেহেরার কাছে। যদিও দরজার নকল চাবি তৈরি করতে অসুবিধে নেই, কিন্তু তাতে উপকার হবে সামান্যই। কারণ, দরজায় লাগানো আছে একটা বিপদঘণ্টি। দরজা খুললেই সেই ঘণ্টি বাজতে শুরু করে। বিপদঘণ্টিটা বন্ধ করা যায় একমাত্র ভল্টের ভেতর থেকে। এবং সেটা করতে গেলেও তিনটে চাবির দরকার। এ ছাড়া, একটুও না-বাজতে যদি সেই ঘণ্টি বন্ধ করা হয়, তা হলে ভল্টের দরজা আর খুলবে না—বাইরে থেকেও না, ভেতর থেকেও না।’