‘আমার মতো কাজের লোক আর আপনি পাবেন না। তা ছাড়া, আমি না-হলে আর একটা বইও আপনি নিজে লিখতে পারবেন না।’
‘শিগগির মালপত্র গুছিয়ে রওনা হও, কিংশুক, নইলে তোমাকে আমি ঘাড় ধরে বের করে দেব!’
‘আপনাকে এর জন্যে পস্তাতে হবে।’ এই কথা বলে কিংশুক ঘরে ছেড়ে চলে গেল।
হ্যাঁ, এইভাবেই অনিন্দ্যসুন্দরের জীবনের শেষ দিনটা শুরু হয়েছিল। রমেন গুপ্তর চিঠি এবং কিংশুকের সঙ্গে ঝগড়া। একই ঘটনা হুবহু দুবার ঘটলে কীরকম অদ্ভুতই না-লাগে। যেন এ-ঘটনা আগেও ঘটেছে—হয়তো কোনও স্বপ্নে…।
এ-চিন্তায় চমকে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর। স্বপ্ন? দেবদূত সূর্যকান্তের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার ব্যাপারটা সত্যিই কোনও স্বপ্ন নয় তো?’
তাঁর অভিনব চিন্তাধারায় বাধা দিয়ে ঝনঝন শব্দে টেলিফোন বেজে উঠল। এক্সটেনশান ফোনটা তাঁর হাতের কাছেই। সুতরাং যান্ত্রিকভাবেই ফোন তুললেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘হ্যালো?’
‘সূর্যকান্ত বলছি।’
‘কে সূর্য—ও হ্যাঁ, কী ব্যাপার? কোত্থেকে বলছেন?’
‘কোত্থেকে বলছি।’ সূর্যকান্ত অপরপ্রান্তে যেন অবাক হল: ‘বোকার মতো প্রশ্ন করছেন কেন, মিস্টার চৌধুরী?’
‘কী—কী চাই বলুন?’
‘দেখলাম, ঠিকমতো পৃথিবীতে পৌঁছেছেন কিনা। কেমন চলছে?’
‘সবে তো এলাম—এখনও তো ভালো করে শুরুই করতে পারিনি!’
‘ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়ুন, মিস্টার চৌধুরী। জানেন তো, হাতে সময় বেশি নেই। বিদায়।’
‘বিদায়।’ ফোন নামিয়ে রাখলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
যাক, একটা ব্যাপারের অন্তত নিষ্পত্তি হল। কোনও স্বপ্ন তিনি দেখেননি। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজে নেমে পড়া যাক। কিন্তু সূর্যকান্ত যদি সর্বক্ষণ এরকম উঁকি মেরে দেখেন, তা হলে কি স্বস্তিতে কাজ করা যাবে?
পরবর্তী তিরিশ মিনিট তাঁর কেটে গেল হাত-মুখ ধোওয়া, দাড়ি কামানো ও পোশাক-পরিচ্ছদ পালটানোর ব্যস্ততায়। কিংশুকের কথা ভাবছিলেন তিনি—শান্ত, ভদ্র, বিনয়ী কিংশুক তার জঘন্য স্বরূপ প্রকাশের জন্য। এতদিন থাকতে আজকের দিনটাই বেছে নিল! হ্যাঁ, সুন্দর সান্যালের নাম ও খ্যাতির প্রতি কিংশুকের নির্লজ্জ লোভ রয়েছে—যে সুন্দর সান্যাল তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয়। না, কিংশুক বোসের যথেষ্ট খুনের মোটিভ রয়েছে।
এরপর কী যেন হয়েছিল?
সবিস্ময়ে অনিন্দ্যসুন্দর আবিষ্কার করলেন, তাঁর কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে, ঠিক রাত এগারোটায়, স্টাডি-রুমে, হাতির দাঁতের হাতলওলা কাগজ-কাটার ছুরিতে তাঁকে খুন হতে হবে। তাছাড়া আর কিছুই তাঁর মনে পড়ছে না। দেবদূতের কাছ থেকে আরও কিছু খবরাখবর নিয়ে এলে ভালো হত।
কিন্তু অন্যদিকে ভাবতে গেলে, এই বেশ হয়েছে। ভবিষ্যতের প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি আগে থেকে দেখতে পেলে তিনি হয়তো শিউরে উঠতেন। আর, এভাবে তিনি বেশ খোলা মনে তদন্তের কাজ করতে পারবেন।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার পথে অনিন্দ্যসুন্দর টের পেলেন, তাঁর খিদে পেয়েছে। খাওয়ার ঘরে ঢুকে দেখেন, রাঁধুনি সীতার মা তার মেয়ে সীতাকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরির কাজে ইতি টানতে ব্যস্ত। সীতার মায়ের মোটাসোটা ঘামে ভেজা শরীরের দিকে তাকালেন তিনি। তার শ্রান্ত মুখটা তীক্ষ্ন নজরে জরিপ করলেন। ওদিকে মেয়ে সীতা মা-কে টুকিটাকি সাহায্য করতে ব্যস্ত। মেয়েটা বেশিরভাগই তাঁর স্ত্রীর ফাইফরমাশ খাটে। কিন্তু তাঁকে খুন করার মতো কোনও কারণ ওদের দুজনের মধ্যে খুঁজে পেলেন না অনিন্দ্যসুন্দর। তা ছাড়া প্রতিদিন রাতে ওরা বাড়ি চলে যায়। সুতরাং সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে ওদের দুজনের নাম তিনি স্থির বিশ্বাসে বাতিল করলেন।
‘তাড়াতাড়ি জলখাবার খেয়ে নিন, বড়বাবু,’ সীতার মা পাঁউরুটি ও ডিমের পোচ তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘রান্নাবান্না সময়মতো শেষ করতে হবে। দুপুরে বৌদিমণি একজনকে নেমন্তন্ন করেছেন।’
‘কাকে?’
‘রণবিলাসবাবুকে।’
এইবার মনে পড়েছে! এ-ঘটনাও প্রথমবারের পুনরাবৃত্তি। রণবিলাস দত্ত। বিশাল চেহারার যুবক। মাথায় একরাশ কোঁকড়ানো চুল।
‘গুডিমর্নিং, ডার্লিং।’
একটা ঠান্ডা চুম্বনের চকিত হালকা ছোঁয়ায় ঘুরে দাঁড়ালেন অনিন্দ্যসুন্দর। একটা তীক্ষ্ন চিন্তা বর্শার মতো হাওয়া কেটে ছুয়ে গেল তাঁর মনের ভেতর দিয়ে—এ-চুম্বন বিশ্বাসঘাতী। কিন্তু নম্রস্বরেই তিনি উত্তর দিলেন, ‘গুডমর্নিং, তৃণা।’ বিব্রত অপ্রস্তুত চোখে একবার দেখলেন সীতা ও তার মায়ের দিকে। ওরা তখন চলে যাচ্ছে রান্নাঘরে।
প্রাতরাশের দিকে ক্ষণেকের জন্য অমনোযোগী হয়ে নিজের স্ত্রীকে চোখের নজরে ব্যবচ্ছেদ করলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তৃণা চৌধুরী। আটাশের উগ্র যুবতী—প্রায় তাঁর অর্ধেক বয়েস। হাবেভাবে চলনে-বলনে যেন বিদেশি আধুনিকা। সর্বদা ভীষণ সেজেগুজে থাকে। তবে অপূর্ব সুন্দরী। সেই কারণেই ওকে বিয়ে করেছিলেন অনিন্দ্যসুন্দর। নিজের বয়েসের কথাটা খেয়াল করেননি। তৃণার চোখে দেখতে চেয়েছেন নিজের সর্বনাশ। তাঁর সাধের তৃণা। কিন্তু…।
‘রণবিলাস তা হলে দুপুরে খেতে আসছে?’
‘তোমার কি আপত্তি আছে, ডার্লিং?’
‘হ্যাঁ, আপত্তি আছে। একটা কপর্দকহীন ইয়াং অ্যাথলিট আমার বাড়িতে ঘুরঘুর করে বেড়াবে আর আমার বউয়ের দিকে হ্যাংলার মতো চেয়ে থাকবে, তাতে আমার যথেষ্ট আপত্তি আছে।’