দেবদূত সূর্যকান্ত হাসল। বলল, ‘এবার আপনার কথা ধরতে পেরেছি, মিস্টার চৌধুরী। কিন্তু যে-প্রশ্নের উত্তর আপনি জানতে চান তা যথাসময়ে আমাদের হাতে আসবে। এখন একটু ধৈর্য ধরে শান্ত হোক—।’
‘খুনির পরিচয় আমাকে জানতেই হবে,’ অনিন্দ্যসুন্দর উদ্দেশ্যে অটল, ‘সেটা না-জানা পর্যন্ত আমার সুখ নেই, শান্তি নেই। পিঠে ছুরি মেরে খুন করেছে! ওঃ কী আস্পর্ধা!’
সূর্যকান্ত সান্ত্বনার সুরে বলল, ‘মিস্টার চৌধুরী, অল্পেতে হতাশ হবেন না। আগে এ-জায়গাটা ঘুরে-ফিরে দেখুন। যেসব সুখ-সুবিধে এখানে আছে…।’
অনিন্দ্যসুন্দর চেয়ারে এলিয়ে পড়লেন, মেঝের দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘আমি কিচ্ছু দেখতে চাই না। এসব সুখ-সুবিধে শুধু কথার কথা।’
‘মিস্টার চৌধুরী!’
‘মিথ্যে। সব মিথ্যে। সুখ! শান্তি! আমার মনে এতটুকু সুখ নেই। আমার এখানে একটুও ভালো লাগছে না।’
‘এখানে আপনার ভালো লাগতে বাধ্য,’ সূর্যকান্তের স্বরে আতঙ্ক উঁকি মারল ‘এখানে সুখী না-হওয়াটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কারণ এটা স্বর্গ—আপনি স্বর্গে রয়েছেন, মিস্টার চৌধুরী।’
‘স্বর্গ না ঘেঁচু! আমার এখানে একটুও ভালো লাগছে না।’
দেবদূত উঠে দাঁড়াল। সুন্দর মার্বেল পাথরের মেঝেতে নগ্ন পায়ে নিঃশব্দে পায়চারি করতে লাগল। আপনমনেই বারকয়েক বিড়বিড় করে বলল, ‘কী অদ্ভুত কাণ্ড! নাঃ, এ অসম্ভব!’ তারপর অনিন্দ্যসুন্দরের দিকে ফিরে বলল, ‘মিস্টার চৌধুরী, আর-একবার ভেবে দেখুন। আপনি…।’
‘না, আমার একটুও ভালো লাগছে না।’
‘দয়া করে একটু বোঝার চেষ্টা করুন, মিস্টার চৌধুরী।’ সূর্যকান্ত অনুনয় করল, ‘আপনি যদি এভাবে সারা স্বর্গে ঘুরে বেড়ান আর বলতে থাকেন, আপনার মনে এতটুকু সুখ-শান্তি নেই, তা হলে আমাদের সম্মান, সুনাম সব কোথায় যাবে বলুন তো? স্বর্গে এসে আপনার মনে সুখ নেই এ-কথা শুনলে, লজ্জায়, অপমানে দেবরাজ ইন্দ্রের যে মাথা কাটা যাবে!’
‘বিশ্বাস করুন, আমার মনে এতটুকু শান্তি নেই।’ অনিন্দ্যসুন্দর আবার বললেন, এবং তাঁর অভিব্যক্তিতেও সে-ইঙ্গিত স্পষ্ট।
‘ঠিক আছে, আমি দেবরাজ ইন্দ্রকে জিগ্যেস করে দেখছি।’ সূর্যকান্ত বলল। তার অভিব্যক্তি দেখে বোঝা গেল, এইমুহূর্তে সুখ এবং শান্তি তার মন থেকেও উবে গেছে। একটু ইতস্তত করে সে আবার বলল, ‘দেবরাজ এত ব্যস্ত থাকেন…তা ছাড়া আজকাল তাঁর মেজাজটাও ভালো নেই। কিন্তু তাঁকে তো বলতেই হবে। নইলে তিনি যদি একবার জানতে পারেন যে, স্বর্গে এসেও একজন মানুষ অসুখী, তা হলে আমাকেই দোষ দেবেন। আমি এই ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার, মিস্টার চৌধুরী। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এখানকার সব দায়দায়িত্ব আমার ঘাড়েই চাপবে।’
‘ভালো না-লাগলে কী করব বলুন!’
শিউরে উঠে দেবদূত আবার পায়চারি শুরু করল। খোলা জানলা দিয়ে মাঝে-মাঝে ভেসে আসছে উচ্ছ্বল হাসির টুকরো শব্দ, কখনও-বা সঙ্গীতের হালকা সুর। কিন্তু ঘরের ভেতরে অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরী গম্ভীর হতাশ মুখে বসে।
হঠাৎই সূর্যকান্তের মুখে হাসি ফুটে উঠল। দ্রুতপায়ে নিজের টেবিলের কাছে ফিরে গেল সে, বসল চেয়ারে।
‘মিস্টার চৌধুরী, আপনি তো রহস্য গল্পের লেখক,’ দ্রুত স্বরে বলতে শুরু করল দেবদূত, ‘সূত্র তৈরি করতে বা খুনিদের ফাঁদে ফেলতে আপনার জুড়ি নেই, কী বলেন?’
‘তা বলতে পারেন।’
সূর্যকান্ত বলে চলল, ‘যে-মতবলটা আমার মাথায় এসেছে সেটা পুরোপুরি বেআইনি, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এ ছাড়া পথ নেই। মিস্টার চৌধুরী, যদি আপনাকে আবার পৃথিবীতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, তা হলে আপনি পারবেন নিজের হত্যা-রহস্যের সমাধান করতে? কী মনে হয় আপনার?’
‘সে আমি বোধহয়…।’
‘এর বেশি আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।’ কঠোর স্বরে বলল সূর্যকান্ত।
‘চেষ্টা করে দেখতে পারি, কিন্তু আমি কীভাবে…?’
‘খুব সহজ।’ বাধা দিয়ে বলল সূর্যকান্ত, ‘আপনি এখন পরলোকে বাস করছেন, সুতরাং সময় বলে এখানে কিছু নেই। আমরা শুধু যা করব, তা হল, একটা সময়ের পুনরাবৃত্তি ঘটাব, মানে, অ্যাকশন রিপ্লে করব…ধরুন, একটা দিন। আপনি পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে আপনার মানবজীবনের শেষ দিনটা আবার নতুন করে বাঁচবেন। দেখুন…এই যে! আপনি মারা গেছেন রাত ঠিক এগারোটায়। সেইদিন সকাল ঘুম ভাঙার পর থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত সময় আপনাকে দেওয়া হল।’
‘মাত্র একটা দিন?’ অনিন্দ্যসুন্দরের ভুরু কুঁচকে উঠল: ‘ওইটুকু সময়ে কি পারব?’
‘তা যদি না-পারেন, তা হলে চেষ্টা করে আর…।’
‘না, পারব।’ ঝটিতি বলে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘বলুন, কখন যেতে হবে?’
‘এক্ষুনি। কিন্তু প্রথমেই একটা কথা বলে রাখি, মিস্টার চৌধুরী। জীবনের শেষ দিনটার প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা এই খাতায় লেখা রয়েছে, সুতরাং সেরকম কোনও তথ্যগত পরিবর্তন আপনি করতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, একটু-আধটু গোয়েন্দাগিরি তো আপনাকে করতেই হবে, যেটা আপনি প্রথমবারে করতে পারেননি। আর, দরকার হলে খাতায় অল্পস্বল্প মোছামুছি আমি করে নেব, কিন্তু সেরকম বড় কিছু পালটাতে গেলে ভীষণ মুশকিলে পড়তে হবে।’
‘কিন্তু—।’
‘সোজা কথায়, বড়সড় কোনও ওলটপালট ছাড়াই আপনাকে ম্যানেজ করতে হবে। এতে কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। মনে রাখবেন, মরণশীল প্রাণীদের যে-বর ক্বচিৎ-কখনও দেওয়া হয়, সেই অমূল্য বর আপনাকে দেওয়া হবে।’