আমার চিৎকার অনির্বাণ টু শুনতে পেল বলে মনে হল না। কেরোসিনের ক্যানটা ঝাঁকিয়ে-ঝাঁকিয়ে তরলের শেষ ফোঁটাটুকু পর্যন্ত নিজের গায়ে ঢেলে দিচ্ছিল।
‘…তারপর ছুটে রান্নাঘরের গিয়ে দেশলাইটা নিয়ে এলাম…’ কথা বলতে-বলতে ছুটে বেরিয়ে গেল ও। এবং কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই একটা দেশলাইয়ের বাক্স নিয়ে ফিরে এল। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘তারপর…তারপর…।’
ফস করে দেশলাই জ্বলে উঠল। তার সঙ্গে জ্বলে উঠল অনির্বাণ। দাউদাউ আগুনে জ্বলে-পুড়ে খাক হতে লাগল।
হঠাৎই এক দমকা বাতাস কোথা থেকে যেন ছুটে এল। ঘরের ভেতরে পাগল করা ঝড় তুলল। সেই ঝড়ে আমার হাতে ধরা বাক্সের ছাই উড়তে লাগল। ছাইয়ের গুঁড়োয় তৈরি কালো মেঘ খ্যাপা মোষের মতো ঘরে বাতাসে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল।
উড়ে বেড়ানো ছাইয়ের কালো কুয়াশা ভেদ করে জ্বলন্ত অনির্বাণকে দেখা যাচ্ছিল। ওর উজ্জ্বল শরীরটা শূন্যে ভেসে উঠে এপাশ-ওপাশ দুলতে লাগল। ওর যন্ত্রণায় ডুকরে ওঠা স্বর শোনা গেল: ‘ওদের ছেড়ে আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম রে। তাই…তাই…তোর হাতের ওই বাক্সের ভেতরে আমিও আছি। কাঞ্চন আর কাঞ্চির সঙ্গে মিশে আছি…মিশে আছি…। আর আজও জ্বলে-পুড়ে মারছি। ওই ছাইয়ের আগুন আজও নেভেনি রে…।’
অন্ধকার রঙের কুকুর
বহু বছর আগের ঘটনা হলেও সেই সন্ধেটার কথা আমি ভুলিনি।
আমার সামনে ছিল আঁকাবাঁকা শীর্ণ নদী। নদীর ওপারে জঙ্গলের গাছপালা। ঝাঁকড়া গাছের পাতার ফাঁকে আগুন রঙের সূর্য ঢলে যাচ্ছিল। আর শীতের ঘোলাটে সন্ধ্যা চুপিচুপি সূর্যকে চাদর মুড়ি দিতে আসছিল।
ঠিক সেই সময়েই আমি শিসের শব্দগুলো শুনতে পেয়েছিলাম। জঙ্গলের দিক থেকে ছুটে আসা তীক্ষ্ন শব্দগুলো আমাকে জানিয়ে দিচ্ছিল ওরা ছুটে আসছে।
তারপরই যা হয়েছিল সে-কথা মনে পড়লেই ভয়ে আমার শরীরটা ঠান্ডা বরফ হয়ে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে চায় সেই মুহূর্তেই।
কী করব এখন!
এত বছর পর যখন ছোটবেলার ওই ঘটনাটার কথা ভাবি তখনও যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সেই সন্ধের দৃশ্যটা জীবন্ত হয়ে ওঠে চোখের সামনে। হিংস্র পশুগুলোর গায়ের বুনো গন্ধ নাকে স্পষ্ট টের পাই।
তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। বয়েস কতই বা হবে! বারো আর তেরোর মাঝামাঝি। শীতের ছুটিতে বড়কদমগাছি বেড়াতে গিয়েছিলাম—আমার বড়মাসির কাছে।
বড়কদমগাছি জায়গাটা রানাঘাট থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে। সেখানে একটা স্কুলে আমার বড়মাসি বাংলার টিচার ছিলেন। আর বড়মেসো জমিজিরেত মাপজোখের কী একটা চাকরি করতেন যেন।
ক্লাস সিক্স থেকেই ডিসেম্বরের শেষে বড়কদমগাছি বেড়াতে যাওয়াটা নিয়মমাফিক শুরু হয়েছিল। বাপি আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতেন বড়মাসি আর মেসোর কাছে। বলতেন, ‘শুধুই কি আর খেলাধুলোয় মেতে থাকবি? এই ক’দিনের ছুটিতে তোর মাসির কাছে বাংলাটাও একটু জোরদার করে নে—।’
তো বাংলা জোরদার কতটা করতাম কে জানে! তবে খেলাধুলোর ব্যাপারটায় মোটেও ফাঁকি দিতাম না। আর সেইসঙ্গে মাছ ধরা।
খেলাধুলোর আমার সঙ্গী ছিল রাহুল আর পিংকি। বড়মাসির ছেলে আর মেয়ে।
রাহুল আমার চেয়ে মাসছয়েকের ছোট। আমরা তিনজনের মিলে কী হুড়োহুড়িই না করতাম! আর মাছ ধরার নেশায় আমার মাস্টারমশাই ছিলেন বড়মেসো।
বড়কদমগাছি জায়গাটা গ্রাম হলে কী হবে, ছবির মতো সুন্দর। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। টালির চাল আর টিনের চালের মাটির বাড়িগুলোর ফাঁকে-ফাঁকে এখানে-ওখানে কতরকমের ছোট-বড় গাছ।
আমরা তিনজনে ঘোর দুপুরে সেইসব গাছের আড়ালে লুকোচুরি খেলতাম, গাছের পেয়ারা, কুল, জারুল পেড়ে ইচ্ছেমতো খেতাম। আর বিকেলে রাহুলের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দল বেঁধে ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠতাম।
সবমিলিয়ে দিনগুলো ছিল দারুণ।
বড়কদমগাছিতে একটিমাত্র নদী ছিল। নাম বউনি। বহুকাল আগে গ্রামের এক নতুন বউ বিয়ের সাজগোজসমেত ওই নদীতে ডুবে মারা যায়। তারপর থেকেই ওই নাম—বউনি। লোকজনের কাছেই শুনেছি, এই সরু নদীটা নাকি চুর্নি নদীতে গিয়ে মিশেছে।
বউনি নদীর এপারে আছে শ্মশান। আর ওপারটায় ঘন জঙ্গল। তাই খুব একটা কেউ নদীর দিকে যায় না। আর যদি বা যায়, তা হলে সন্ধের আগেই ফিরে আসে।
বড়মেসোর ভীষণ মাছ ধরার শখ। ছুটির দিন হলেই মেসো টোপ-বঁড়শি নিয়ে বউনির পাড়ে গিয়ে হাজির। কাপড়ের সাদা টুপি মাথায় দিয়ে নদীর পাড়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তারপর দিনের শেষে ছ’ইঞ্চি কি আট ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একপিস মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরেন।
কিন্তু তাতেই দেখেছি মেসোর কী আনন্দ! বঁড়শিতে ধরা মাছ নিয়ে হেঁড়ে গলায় গান গাইতে-গাইতে বাড়ি ফেরেন। তারপর সেই মাছ কী-কী পদ্ধতিতে রান্না করতে হবে তা নিয়ে বড়মাসিকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। তখন মাসি আর মেসোয় তর্ক-বিতর্ক লেগে যায়। আর আমি, রাহুল, পিংকি সেই মজার ‘আলোচনা’-র নীরব দর্শক।
মেসোর কাছেই শুনেছি ছিপের ইংরেজি ‘অ্যাংগল’, আর যারা ছিপ দিয়ে মাছ ধরে তাদের বলে ‘অ্যাংলার’।
মেসো আমাকে সবসময় বলতেন, ‘বুঝলি, মাছ ধরায় যে কী আনন্দ সেটা নিজে হাতে মাছ না ধরলে কখনও বুঝবি না। এ একটা দারুণ পজিটিভ নেশা। এতে কনসেনট্রেশান বৃদ্ধি পায়।’