আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দৃশ্যটা দেখতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না।
অনেকক্ষণ পর প্রায় ফিসফিস করে ওকে জিগ্যেস করলাম, ‘কবে হল?’
ও বলল, ‘হয়েছে। দাঁড়া, তোকে একটা জিনিস দেখাই। যে জন্যে তোকে এতদূর ডেকে এনেছি…।’
কথাগুলো বলতে-বলতেই ঘরটার আর-একটা পোড়া দরজা দিয়ে অনির্বাণ টু চট করে কোথায় চলে গেল।
আমার কেমন যেন অপ্রস্তুত লাগছিল। লোকের বাড়িতে এলে আগে লোক একটু জলখাবারের ব্যবস্থা করে, চা-টা দেয়—তারপর…। তার বদলে ও এসব কী করছে!
বাড়িটায় কোনও লোকজনের আওয়াজ নেই। চারপাশে পোড়া গন্ধ। ওর আচরণও কেমন অদ্ভুত। তা ছাড়া…।
একটা টিনের বাক্স হাতে ফিরে এল অনির্বাণ। বাক্সটা কালচে, তোবড়ানো। জুতোর বাক্সের চেয়ে মাপে খানিকটা বড়। দেখেই বোঝা যায় বাক্সটা অনেক পুরোনো।
অনির্বাণ বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘ওয়ান, তোকে এটা দেব বলে এতদিন ওয়েট করেছি। স্কুলে তুই আর আমি ছিলাম যাকে বলে হরিহর আত্মা। তাই এটা আমি তোর জন্যে রেখেছি। তুই এটার একটা গতি না করলে আমি শান্তি পাচ্ছি না। প্লিজ, ওয়ান, তুই আমাকে এইটুকু হেলপ কর…।’
বাক্সটা ও আমার হাতে দিল। আমি ওর কথা শুনতে-শুনতে যেন হিপনোটাইজড হয়ে গিয়েছিলাম। রোবটের মতো হাত বাড়িয়ে বাক্সটা নিলাম।
বাক্সটা বেশ হালকা কিন্তু হাতে গরম ঠেকল। হাত পুড়ে যাওয়ার মতো নয়, কিন্তু বেশ গরম।
কী আছে বাক্সের ভেতরে?
সেই প্রশ্নটাই করলাম ওকে, ‘এর ভেতরে কী আছে রে?’
অনির্বাণ প্রশ্ন শুনে উসখুস করে উঠল। বারকয়েক মেঝের দিকে তাকাল। আঙুলে আঙুল ঠেকিয়ে নখের ডগা খুঁটতে লাগল।
‘কী আছে বলবি তো!’
একটু ইতস্তত করে ও বিড়বিড় করে বলল, ‘ওয়ান, কিছুদিন আগে আমার ফ্যামিলিতে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়। আচমকা এই ঘরটায় আগুন লেগে যায়। আমি বাড়িতে ছিলাম না। তারকেশ্বরে একটা কাজে গিয়েছিলাম। ফিরে দেখি সব শেষ! কাঞ্চন…আর কাঞ্চি…আমার পুতুলের মতো ফুটফুটে মেয়েটা…ওরা আর নেই। আগুন…আগুন ওদের খেয়ে ফেলেছে…খেয়ে চেটেপুটে সব শেষ। শেষ!’ কথা বলতে-বলতে কেঁদে ফেলল অনির্বাণ।
‘সে কী রে! বলিস কী! আশপাশের কেউ কিছু করতে পারল না?’
মাথা নাড়ল অনির্বাণ: ‘নাঃ। কিছু করে ওঠার আগেই সব শেষ। সব জ্বলে-পুড়ে খাক।’
হঠাৎই ঘরের ভেতরটা আঁধার হয়ে এল। একইসঙ্গে মেঘের ডাক কানে এল।
অবাক হয়ে একটা জানলার দিকে তাকালাম।
আশ্চর্য! একটু আগেই খোলা জানলা দিয়ে একটা নারকেল গাছ আর বিকেলের রোদ দেখা যাচ্ছিল—এখন নারকেল গাছটা আছে, তবে রোদ লুকিয়ে পড়েছে। আর গাছটাও অস্পষ্ট, ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।
অনির্বাণ দেওয়ালের পোড়া সুইচবোর্ডের দিকে হাত বাড়িয়ে বোধহয় একটা সুইচ টিপে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে একটা বালব হলদেটে আলো ছড়িয়ে দিল ঘরে।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। পোড়া ঘর, বাইরের আঁধার, বালবের আলোয় তৈরি হওয়া কালো-কালো ছায়া, আর সামনে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা অন্যরকম অনির্বাণ আমাকে কেমন যেন ভয় পাইয়ে দিল।
‘কী আছে এই বাক্সের ভেতরে?’ ফাঁপা গলায় ওকে প্রশ্ন করলাম।
‘বাক্স খুলে দেখ…।’
আমার ভেতরে একটা জেদ তৈরি হচ্ছিল। ভয় পেলেও সেই জেদের জোরেই একটানে বাক্সের ঢাকনা খুলে ফেললাম।
বাক্স ভরতি কালো ছাই।
‘ওগুলো কাঞ্চন আর কাঞ্চির ছাই…।’ অনির্বাণ টু বলল।
আমি সম্মোহিতের মতো ছাইগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
‘এগুলো তুই গঙ্গায় ভাসিয়ে দিস…।’ ঠোঁট টিপে ও কান্না চাপতে চাইল। তারপর আর্ত সুরে বলল, ‘দিবি তো?’
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ—দেব।’ তবে একইসঙ্গে ভাবছিলাম, ওর বউ আর মেয়ে কবে আগুনে পুড়ে মারা গেছে? ও বলছিল, ‘কিছুদিন আগে।’ তা হলে ছাইগুলো এখনও গরম থাকে কেমন করে?
আমার অবাক ভাবটা অনির্বাণের চোখে পড়ল। ও বলল, ‘ভাবছিস ছাইগুলো এখনও গরম আছে কেমন করে, তাই না? তা হলে শোন, ওই ছাইয়ের আগুন এখনও নেভেনি। এখনও আমি জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা, তোর যদি এমন হত তুই কী করতিস? যদি তোর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ দুজন এরকম আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যেত তা হলে তোর মনের অবস্থাটা কী হত? বল, সত্যি করে বল। একটিবার বল…।’
ওর প্রত্যাশা ভরা সজল চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মায়া হল। কে যেন আমাকে দিয়ে আচমকা বলিয়ে নিল, ‘কিছু মনে করিস না। ওরকম হলে আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করত না…।’
‘ঠিক বলেছিস।’ তর্জনী তুলে উত্তেজিতভাবে সায় দিল অনির্বাণ। তাড়াতাড়ি কথা বলতে গিয়ে ওর জিভ জড়িয়ে গেল: ‘তাই কী করেছিলাম জানিস?’ কথাটা বলেই ও একছুটে ভেতরের দরজা পেরিয়ে কোথায় চলে গেল। কিন্তু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই একটা প্লাস্টিকের জেরিক্যান হাতে আবার ঘরে ফিরে এল। ক্যানের ছিপি খুলতে-খুলতে বলল, ‘কেরোসিন নিয়ে নিজের গায়ে মাথায় ঢালতে শুরু করেছিলাম…’ জেরিক্যান উলটে পাগলের মতো নিজের শরীরে কেরোসিন ঢালতে লাগল ও। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলতে লাগল, ‘এই যে—এইভাবে। এইভাবে…ঢালছিলাম…।’
কেরোসিনে ওর মাথার চুল ভিজে গেল। ভিজে গেল সারা শরীর, গায়ের জামাকাপড়। ঘরের মেঝেতে কেরোসিনের বন্যা বয়ে গেল। তীব্র গন্ধে চারদিক ভেসে গেল।
‘অনির্বাণ! অনির্বাণ! কী করছিস তুই?’ আমি ভয় পাওয়া গলায় চিৎকার করে উঠলাম।