কলেজের পাট শেষ করে আমি যখন চাকরি করছি তখন আমাদেরই এক স্কুলের বন্ধু কমলেশের সঙ্গে হঠাৎ দেখা। ও বলল, ‘টু, ওয়ান তোকে ফোন করবে। কোত্থেকে যেন আমার ফোন নাম্বার জোগাড় করে আমাকে ফোন করেছিল। নেক্সট উইকে শনিবার ওর বিয়ে। আমাকে যেতে বলেছে। তোকে বলবে। তবে আমার বোধহয় যাওয়া হবে না। কোন ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর—মানে, আসনপুর না কেশবপুর—কোথায় যেন থাকে। যাকগে, তোকে ও ফোন করবে।’
অনির্বাণ আমাকে ফোন করেছিল। বিয়েতে নেমন্তন্নও করেছিল। কিন্তু আমার যাওয়া হয়নি। অফিসের কাজের চাপ আর কেশবপুরের দূরত্ব—এই দুটো ফ্যাক্টরই বাদ সেধেছিল।
বিয়েতে যাইনি বলে অনির্বাণ টু অভিমান করে আমাকে আর কখনও ফোন-টোন করেনি। আমিও সংকোচে ওকে ফোন করে উঠতে পারিনি।
এরপর বছর ছয়েক কেটে গেছে। ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। কেমন একটা ‘কিন্তু-কিন্তু’ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সময়টা কেটে গেছে। তারপর হঠাৎই ওর ফোন এল। মাত্র তিনদিন আগে।
‘ওয়ান?’
‘হ্যাঁ—।’
‘টু বলছি।’
‘অনির্বাণ। কেমন আছিস? শোন, আমি এক্সট্রিমলি সরি। তোর বিয়েতে যেতে পারিনি রে। এমন কাজের প্রেশার পড়ল যে, কী আর বলব। আমি…।’
‘ওসব ফালতু কথা ছাড়, ওয়ান।’ আমাকে রুক্ষভাবে থামিয়ে দিল অনির্বাণ: ‘ওসব তো হাফডজন বছরের পুরোনো কথা। আজ খুব জরুরি দরকার তোকে ফোন করেছি। তোকে আমার বাড়িতে একবার আসতেই হবে। ভীষণ দরকার। কবে আসবি বল?
আমি ওকে আশ্বস্ত করার জন্যে বললাম, ‘যাব, যাব। কিন্তু তোর কী হয়েছে বল তো? তোর কথা শুনে তোকে ভীষণ আপসেট বলে মনে হচ্ছে…।’
‘তুই এলে সব বলব। তোর কাছে তো আমার গোপন কিছুই নেই! বল, কবে আসবি?’
একটু চিন্তা করে আমি বললাম, ‘পরশু যাব। তা তোর ফ্যামিলি লাইফ কেমন চলছে বল। ওয়াইফ কেমন আছে? ছেলেমেয়ে ক’টা?’
অনির্বাণ টু চুপ করে গেল। কয়েকসেকেন্ড পর একটু যেন বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘ওদের নিয়েই তো প্রবলেম। ওয়াইফ…আর আমার চার বছরে ফুটফুটে মেয়েটা। তুই পরশু আয়, ওয়ান। আমাকে ঝোলাস না যেন! তুই এলে সব বলব। তোর হেলপ না পেলে আমার সর্বনাশ হবে…।’
আরও কয়েকটা কথার পর আমি শপথ করে বলছিলাম, ‘…পরশু বিকেলে তা হলে তোর সঙ্গে দেখা হচ্ছে। প্রমিস।’
‘থ্যাংকু ইউ, ভাই। আমি তোর জন্যে কেশবপুর মোড়ে জামগাছতলায় ওয়েট করব…।’
এখন জামগাছতলায় দাঁড়ানো লোকটাকে আমি খুঁটিয়ে দেখছিলাম। নাঃ, অনির্বাণ টু আগের চেয়ে অনেক কালো হয়ে গেছে। চেহারাও অনেক শুকিয়ে গেছে। এই বয়েসেই গাল বসে গেছে। ঠোঁট খসখসে। চোখগুলো বড় বেশি সাদাটে।
ও আমাকে বাড়ির পথ ধরে এগিয়ে নিয়ে চলল। আমি বারবার বারণ করা সত্ত্বেও ছাতাটা খুলে মাথার ওপরে ধরে রইল।
চওড়া রাস্তা ছেড়ে আমরা সরু পথে ঢুকে পড়লাম। দুপাশে বাঁশগাছ, জবাফুলের গাছ, ভেরেন্ডার বেড়া। কয়েকটা ছোট-ছোট ডোবা। সেখানে লুকোনো চুনোমাছ বুড়বুড়ি কাটছে।
পথে বেশ কয়েকটা কুঁড়েঘর চোখে পড়ল। বাখারির কাঠামোয় গোবর আর মাটির চাপান দেওয়া দেওয়াল। কোথাও-কোথাও মাটির চাঙড় খসে পড়েছে। সেই কুঁড়েঘরের ফাঁক দিয়ে কয়েকটা দোতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছিল।
উঁচু-নীচু কাঁচা পথ পেরিয়ে একটা সমতল মাটির উঠোনে এসে দাঁড়ালাম। আরও একটু এগোতেই একটা মামুলি দোতলা বাড়ি। তার একটা অংশ পুড়ে কালচে হয়ে ধসে পড়েছে।
সেই বাড়িটার দিকে আঙুল দেখিয়ে অনির্বান টু বলল, ‘আয়, এটাই আমার বাড়ি। দেখেছিস, কীরকম ড্যামেজ হয়ে গেছে!’
পথে আসার সময় অনির্বাণ ওর স্ত্রী আর মেয়ের কথা বলছিল। কাঞ্চন আর কাঞ্চি। ওদের নিয়ে একসঙ্গে বেঁচে থাকাটাই একটা স্বপ্নের মতো। কী দারুণ জীবন! অনেক ভাগ্য করে মানুষ এরকম জীবন পায়। আরও কত ভালো-ভালো কথা।
ওর কথা শুনতে-শুনতে মনে হচ্ছিল এবার বাবা-মায়ের কথা মেনে নিয়ে বিয়েটা করে নিলেই হয়! স্বপ্নের মতো দারুণ জীবন তো সবাই চায়!
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই কেমন একটা পোড়া-পোড়া গন্ধ পেলাম। দুধ উথলে উনুনে পড়লে যেমন পোড়া গন্ধ বেরোয়।
আমি নাক টেনে গন্ধটা কোনদিক থেকে আসছে সেটা ঠাওর করতে চেষ্টা করছিলাম। অনির্বাণকে জিগ্যেস করলাম, ‘কী পুড়ছে রে?’
ও নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘আমার বাড়ি। বাড়িটা পুড়ছে।’
আমি ওর ঠাট্টার মানে বুঝতে না পেরে ওর মুখের দিকে তাকালাম। মনে হল মুখটা যেন বিষণ্ণ পাথর দিয়ে তৈরি।
বাড়িতে ঢুকে অনির্বাণ দোতলার সিঁড়ি দিকে এগোল। আমি বাধ্য অতিথির মতো ওর পিছু নিলাম। আমাদের পায়ের শব্দ কেমন যেন ফাঁপা প্রতিধ্বনি তুলছিল।
আমি কান পেতে কাঞ্চন বা কাঞ্চির গলার আওয়াজ শুনতে চাইলাম, কিন্তু পেলাম না। লক্ষ করলাম, যে-অনির্বাণ এতক্ষণ ধরে এত কথা বলছিল সে বাড়িতে ঢোকার পর থেকে কীরকম যেন চুপচাপ হয়ে গেছে।
আমরা দোতলায় উঠে এলাম।
সামনেই চওড়া বারান্দা। চকচকে লাল মেঝে। রেলিঙের ওপরে গ্রিল দেওয়া।
বারান্দার ডানদিকে একটা পোড়া দরজা। সেটা পেরিয়ে একটা ঘর। তার দেওয়ালগুলো কালো, ফাটল ধরা, কোথাও-কোথাও ধসে পড়েছে।
পোড়া গন্ধটা আরও তীব্র হয়ে নাকে ধাক্কা মারল।
সেই ঘরটার মধ্যে আমাকে নিয়ে ঢুকল অনির্বাণ। সঙ্গে-সঙ্গে পোড়া গন্ধটা শ্মশানের গন্ধ হয়ে গেল।
আমার চারপাশে পোড়া ক্যালেন্ডার, পোড়া দেওয়াল-ঘড়ি, পোড়া খাট-বিছানা, পোড়া জানলা, পোড়া আলনার জামাকাপড়, পোড়া ড্রেসিংটেবিল, আর পোড়া ফটোগ্রাফ।