‘এর একটাই উত্তর,’ বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘নিশ্চয়ই আমার কাছে কোনও রুমাল ছিল না।’
‘ঠিক।’ সম্মতি জানাল দেবদূত: ‘এবার বলুন তো, ওই পাঁচজনের মধ্যে কে জানত যে, আপনি সবসময় প্যান্টের বাঁ-পকেটে রুমাল রাখতেন?’
‘বুঝেছি, আপনি কি বলতে চান!’ অনিন্দ্যসুন্দরের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল।
প্রত্যুত্তরে সূর্যকান্তও হাসল: ‘এবারে নিশ্চয়ই আপনি এখানে সুখী হবেন, মিস্টার চৌধুরী।’
‘তৃণার তরুণ প্রেমিক রণবিলাস ছিল আলোর সুইচের কাছে, ‘আত্মগতভাবেই বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘খুনটা ও শেষ না-করা পর্যন্ত রণবিলাস যে আলো জ্বেলে দেবে না, সে-ভরসা তৃণার ছিল। তা ছাড়া, তৃণার সঙ্গে কোনও রুমাল ছিল না। ছুরির হাতলটা যদি ও শাড়িতে মুছতে যেত, তা হলে শাড়িতে রক্ত লেগে যাওয়ার ভয় থাকত। সুতরাং আমার রুমালটাই ও বেছে নিয়েছে। আমি রুমাল কোথায় রাখি, সেটা সবচেয়ে ভালো জানত তৃণাই—আর কেউ নয়!’
‘ঠিক আমি যা ভেবেছি তাই, মিস্টার চৌধুরী।’
‘গোয়েন্দাগিরিতে আপনি দেখছি নেহাত কম যান না!’
দেবদূত কষ্টকৃত বিনয়ের ভাব ফুটিয়ে তুলল। নরম সুরে স্বীকার করল, ‘এখানে থাকতে-থাকতে টুকটাক কিছু শিখেছি আর কী। বলতে পারেন একরকম সঙ্গগুণ বা মেলামেশার ফল—।’
‘সঙ্গগুণ? মেলামেশা?’
‘কেন, আপনাকে বলিনি, মিস্টার চৌধুরী? ওঃ হো। প্রথমেই যদি বলতাম, তা হলে আপনি হয়তো এতটা অসুখী হতেন না, বরং খুশিই হতেন। ঠিক আছে, আর দেরি নয়। আসুন, সবার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হলেন পাঁচকড়িবাবু, ইনি দীনেন্দ্রবাবু আর ইনি শরদিন্দুবাবু…।’
‘পাঁচকড়িবাবু, দীনেন্দ্রবাবু, শরদিন্দুবাবু!’
‘হ্যাঁ, মিস্টার চৌধুরী। কেন, আপনি জানেন না, রহস্য-সাহিত্যিকরা মারা গেলে স্বর্গে আসেন!’
অনির্বাণ ছাই
আমাকে নামিয়ে দিয়ে লজঝড়ে বাসটা ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।
ধুলোর কুয়াশা ফিকে হলে চোখের সামনে যা দেখলাম তা যেন ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। যেদিকে দু-চোখ যায় সেদিকেই টিয়াপাখি-রঙের ধানখেত। বিকেলের রোদ পড়ে ঝকঝক করছে। তারই মধ্যে কোথাও-কোথাও বড়-বড় গাছ। দু-একটা পাকা বাড়ি।
পিচের রাস্তা থেকে একটা চওড়া মোরাম বিছানো পথ ডানদিকে চলে গেছে। সেই পথের পাশে একটা বড় জামগাছ। অনির্বাণ এই গাছটার কথা বলেছিল। বলেছিল, ওই গাছের নীচে ও দাঁড়িয়ে থাকবে।
কিন্তু এতবছর পর ওকে কি আমি চিনতে পারব? ও-ও বোধহয় আমাকে চিনতে পারবে না। স্কুলে আমরা একসঙ্গে অনেক বছর পড়েছি বটে, কিন্তু স্কুল ছেড়েছি প্রায় বারো বছর হয়ে গেল। আমাদের দুজনের চেহারাই নিশ্চয়ই অনেক পালটে গেছে।
দেখলাম, গাছতলায় একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা রোগা, কালো, মাথার চুল উড়ছে, হাতে ভাঁজ করা একটা কালো ছাতা। এছাড়া ধু-ধু রাস্তায় আর কেউ নেই। দুটো গাঙশালিক পথের ধারে ঘাসঝোপের মধ্যে খেলা করছিল।
আমি হাঁটতে-হাঁটতে পকেট থেকে সেলফোন বের করলাম। অনির্বাণের নম্বর দেখে ডায়াল করলাম।
দেখলাম, গাছতলার লোকটা পকেট থেকে ওর সেল বের করে কানে দিল।
আমি কথা বললাম, ‘অনির্বাণ?’
‘হ্যাঁ। তুই অনির্বাণ?’
‘অফ কোর্স—অনির্বাণ নাম্বার ওয়ান।’
‘আমি তোর জন্যে গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছি। তুই কোথায়?’
‘তোর দিকেই এগোচ্ছি—পায়ে হেঁটে…।’
এ-কথা যখন বললাম তখন আমাদের মধ্যে মাত্র হাতপাঁচেকের তফাত।
গাছের ছায়ার ভেতরে ঢুকে পড়ে আমি লোকটার একেবারে মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালাম। সেলফোন অফ করে পকেটে ঢুকিয়ে অবাক সুরে চেঁচিয়ে বললাম, ‘তুই অনির্বাণ দুই?’
লোকটা হেসে আমাকে বুকে জাপটে ধরো: ‘ঠিক বলেছিস। আজ কতবছর পরে একের সঙ্গে দুইয়ের দেখা হল বল তো! ভীষণ ভালো লাগছে রে—নতুন করে আবার বাঁচতে ইচ্ছে করছে।’
প্রথম আবেগের ঝাপটা কেটে গেলে হারানো বন্ধুর দিকে ভালো করে তাকালাম। ও-ও আমাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
স্কুলে আমাদের স্কুলে একটা বিরল ঘটনা ছিলাম আমরা দুজন। কারণ, আমাদের দুজনেরই নাম অনির্বাণ সরকার। তাই গুলিয়ে যাওয়ার সমস্যা এড়াতে স্কুলের স্যাররা কখন যেন আমাকে অনির্বাণ ওয়ান, আর ওকে অনির্বাণ টু করে দিয়েছিলেন। আমি মাথায় একটু বেশি লম্বা ছিলাম। হয়তো সেইজন্যেই ‘ওয়ান’ উপাধি পেয়েছিলাম। স্কুলের বন্ধুরা সংক্ষেপে আমাদের বলত ‘ওয়ান’ আর ‘টু’।
টু আমার চেয়ে মাথায় খাটো হলে কী হবে ওর মাথা—মানে, ব্রেন—ছিল নাম্বার ওয়ান। তা ছাড়া ওর রং ছিল টকটকে ফরসা, আর আমি তার ঠিক উলটো—একেবারে কেষ্ট ঠাকুর।
ক্লাসে আমাদের বন্ধুত্বটা কী করে যেন বেশ আঠালো হয়ে গিয়েছিল। মনের সব কথা আমি ওকে খুলে বলতাম। আর ও-ও আমাকে সব কথা খুলে বলত।
নীচু ক্লাসে থেকে ওপরে উঠতে-উঠতে আমরা এক সঙ্গে বড় হচ্ছিলাম। সুখ-দুঃখগুলোকে নতুন করে চিনতে পারছিলাম, আর সেগুলো দুজনে মিলে ভাগ করে নিচ্ছিলাম। সবমিলিয়ে দিনগুলো বেশ কাটছিল।
তারপর স্কুল একদিন ফুরোল। চলে এল এক আর দুইয়ের ছাড়াছাড়ির দিন। বেশ মনে আছে, সেদিন স্কুল ছুটির পরে আমরা দুজনে বোসদের পুকুরের ঘাটে গিয়ে বসেছিলাম। অনেক গল্প করেছিলাম। কেঁদেও ছিলাম।
আজও সব মনে আছে আমার।
তারপর কত মাস কত বছর যে কেটে গেছে! দুইয়ের কথা না ভুললেও স্মৃতির পাতা অনেকটা আবছা হয়ে এসেছিল। মনে-মনে শুধু চাইতাম ও যেখানেই থাক খুশিতে থাক, আনন্দের ধুলো মাখা থাক ওর কপালে। কারণ, অনির্বাণ বেশিরভাগ সময়েই খুব মনমরা হয়ে থাকত। আর একটু যেন চাপা স্বভাবের ছিল।