‘কটা বাজে?’ অভীক প্রশ্ন করল। ও চোখে ভালো দেখতে পায় না।
‘এগারোটা বাজতে তিন।’ দেওয়াল-ঘড়ির সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে আছে কিংশুক বোস।
একটা ভারী নিস্তব্ধতা ঘরে জাঁকিয়ে বসল। তৃণা ও রণবিলাস চকিত দৃষ্টি বিনিময় করল। অন্যান্যরা অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে। ওদের অবিশ্বাসী অভিব্যক্তি এখন পুরোপুরি অদৃশ্য। আর ওদেরই মাঝে বসে খুনি মনে-মনে এক চরম সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে।
হঠাৎ উঠে দাঁড়াল রণবিলাস দত্ত, লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল ঘরের দরজার কাছে। ওর চলার শিকারি চিতার ক্ষিপ্রতা এবং এতটুকু পায়ের শব্দ নেই। সতর্ক হয়ে ওকে লক্ষ করতে লাগলেন অনিন্দ্যসুন্দর, অনুভব করলেন অটোমেটিকের স্পর্শ।
দরজার কাছে গিয়ে থামল রণবিলাস, চকিতে ঘুরে দাঁড়াল।
‘মিস্টার চৌধুরী একটা কথা ঠিকই বলেছেন,’ রণবিলাস দত্ত ধীরে-ধীরে বলতে শুরু করল, ‘অন্যান্যদের চোখের সামনে খুনি যদি খুন করে, তা হলে তাঁরা সাক্ষী দিতে পারবে। এবং তাঁদের নিরাপত্তা পুরোপুরি বজায় থাকবে। কিন্তু যদি সকলের চোখ এড়িয়ে খুনটা করা যায়, তা হলে? তখন কেউই সঠিক বলতে পারবে না, কে খুন করেছে। এ-কথা সত্যি যে, আমাদের প্রত্যেকেরই খুনের মোটিভ রয়েছে, আমাদের সবাইকেই পুলিশ সন্দেহ করবে—এমনকী এরকমভাবেও তারা কেস সাজাতে পারে যে, আমরা পাঁচজনে মিলে প্ল্যান করে মিস্টার চৌধুরীকে খুন করেছি। কিন্তু পুলিশ যদি এই ঘরোয়া বৈঠকের কথা একেবারেই না জানতে পারে? তা হলে আমাদের কারওরই কোনও ভয় নেই, আর খুনি ঠিক প্রথমবারের মতোই আইনের চোখে ধুলো দেওয়ার একই ঝুঁকি নেবে। শুধু যা করতে হবে, তা হল, কোনও প্রত্যক্ষ সাক্ষী না-রেখে রাত ঠিক এগারোটায় মিস্টার চৌধুরীকে খুন করতে হবে।’
এগারোটা বাজতে একমিনিট।
‘কিন্তু সেটা খুনি করবে কীভাবে?’ অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরী তীব্র স্বরে জানতে চাইলেন, কিন্তু সবিস্ময়ে উপলব্ধি করলেন, তাঁর গলার স্বর কাঁপছে, ‘একঘর লোকের সামনে প্রত্যক্ষ সাক্ষী না- রেখে কী করে আমাকে খুন করবে সে?’
রণবিলাস দত্ত হাসল। ঘোরতর শত্রুর হাসি।
‘কেন, সে তো খুব সহজ,’ উত্তর দিল সে, ‘শ্রীযুক্ত সুন্দর সান্যাল, রহস্য-গোয়েন্দা গল্পের প্রখ্যাত লেখক, এটা কী করে আপনার চোখ এড়িয়ে গেল বলুন তো? আমাকে কাজের কাজ যা করতে হবে, তা হল, টুক করে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দেওয়া!’
অনিন্দ্যসুন্দর কিছু করে ওঠার আগেই রণবিলাসের আঙুল পৌঁছে গেল আলোর সুইচে। অন্ধকার নেমে এল চকিতে, অস্তিমান রইল। যে-বিদ্যুতের ঝলক এতক্ষণ প্রায় ধারাবাহিকভাবে আলোর বর্শা নিক্ষেপ করে চলেছিল, এখন, এইমুহূর্তে, উচ্ছৃঙ্খল দুর্বৃত্তের মতো স্তব্ধ হল। উত্তাল আক্রোশে বাইরের দেওয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়া বৃষ্টির শব্দে লোপ পেল সমস্ত পায়ের শব্দ।
নিজের পরিচয় অজ্ঞাত রেখে চলাফেরায় খুনির আর কোনও অসুবিধে নেই!
বিস্ময়ে সাময়িকভাবে বিমূঢ় হয়ে না-পড়লে অনিন্দ্যসুন্দর হয়তো কিছু করতেন। কিন্তু তিনি নিশ্চল নিস্পন্দ হয়ে বসে রইলেন চেয়ারে।
কেউ একজন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা হাত তাঁর মাথাটা ঠেলে দিল সামনে, টেবিলের ওপর। তিনি ঘুমিয়ে পড়লে ঠিক যেমনটা হত। অনিন্দ্যসুন্দর বুঝলেন, অন্য হাতটা তখন খুঁজে বেড়াচ্ছে কাগজ-কাটা ছুরিটা…খুঁজে পেল…শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরল।
আঘাতটায় সেরকম যন্ত্রণা অনুভব করলেন না তিনি।
আবছাভাবে অনিন্দ্যসুন্দর টের পেলেন, যে-হাতটা তাঁর মাথাটা টেবিলে ঠেলে ধরেছিল, সেটা এখন তাঁর প্যান্টের বাঁ-পকেট হাতড়ে বেড়াচ্ছে, তুলে নিচ্ছে তাঁর রুমালটা…এবার খুনি ছুরির হাতল থেকে মুছে ফেলছে তার আঙুলের ছাপ…।
অনিন্দ্যসুন্দরের মাথার মধ্যে যেন তীক্ষ্ন শব্দে ঘণ্টা বেজে চলেছে…।
নাকি সেটা টেলিফোন বেজে ওঠার শব্দ…।
‘সুস্বাগতম, মিস্টার চৌধুরী। একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় ফিরে এসেছেন।’
সূর্যকান্তের টেবিলের সামনে সোনার সিংহাসনে শ্লথ ভঙ্গিতে বসে পড়লেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘পৃথিবীতে কেমন কাটালেন, মিস্টার চৌধুরী?’
‘আমি আবার খুন হয়েছি!’
‘নিশ্চয়ই!’
‘কে খুন করেছে আমাকে?’
দেবদূত সশব্দে হেসে উঠল। সেই হাসিতে গমগম করে উঠল শ্বেতপাথরে অলঙ্কৃত প্রাসাদ।
‘সেটা জানতেই তো আপনি আবার ফিরে গেলেন পৃথিবীতে! আর এখন কিনা সেই একই প্রশ্ন করছেন? আপনি নিশ্চয়ই তৃতীয়বার পৃথিবীতে যাওয়ার কথা ভাবছেন না?’
‘না, ধন্যবাদ,’ শ্রান্ত স্বরে বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘কিন্তু এখানে আমি এতটুকু শান্তি পাব না—।’
‘আবার সেই পুরোনো কথা!’ তড়িঘড়ি বলে উঠল দেবদূত, ‘তার চেয়ে আসুন আপনার খুনের রহস্যটা নিয়ে একটু মাথা ঘামানো যাক। নিজেকে খুনির জায়গায় কল্পনা করুন, মিস্টার চৌধুরী। যখন রণবিলাসবাবু আলো নিভিয়ে দিলেন, তখন আপনি হলে কি টেবিলের কাছে গিয়ে খুনটা করতেন?’
দু-হাতে মাথা রেখে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তারপর বললেন, ‘না, আমি সেটাকে একটা ফাঁদ বলে সন্দেহ করতাম। কারণ, ছুরি বসানোর সময় কেউ হয়তো আলোটা আবার জ্বালিয়ে দিতে পারত, এবং আমি হাতেনাতে ধরা পড়তাম।’
‘ঠিক বলেছেন, মিস্টার চৌধুরী। সেটা প্রচণ্ড ঝুঁকির কাজ হত। এবারে আর-একটা প্রশ্ন। আপনি যদি খুনি হতেন, তা হলে যাকে খুন করলেন তারই পকেট থেকে রুমাল বের করে ছুরি থেকে নিজের আঙুলের ছাপ মুছে ফেলার কী কারণ আপনার থাকতে পারে?’