‘তা হলে আপনি এভাবেই বসে অপেক্ষা করবেন—দেখবেন, খুনি আপনাকে আক্রমণ করতে আসছে। তখনই খুনিকে চিনতে পারবেন এবং আপনার কৌতূহলও মিটে যাবে।’ এ-প্রস্তাব রণবিলাস দত্তের।
হাসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। যেন বন্ধুমহলে কোনও তর্কের উত্তরে বলছেন এমন সুরে জবাব দিলেন, ‘না, তা নয়। সেরকম সাহস আমার নেই, রণবিলাসবাবু, যে শান্তভাবে টেবিলে বসে দেখব, খুনি এসে আমার পিঠের ওপর ঝুঁকে পড়েছে, এবং তারপর, তার ছুরির সামনে নিজেকে উৎসর্গ করব।’
‘তা হলে আর কী পথ আছে, আমি তো বুঝতে পারছি না।’ বিরক্ত তীক্ষ্ন স্বরে তৃণা বলল।
‘সত্যিই তো, তুমি বুঝবে কেমন করে। মন দিয়ে শোনো, স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলছি। এতক্ষণে এটুকু নিশ্চয়ই আঁচ করেছ, একটা মতলব আমার মাথায় আছে। সূর্র্যকান্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা আমি করব না—কারণ সে আমার সঙ্গে চমৎকার ব্যবহার করেছে—এমনকী এই মাঝরাতে আমার এই স্টাডি-রুমে এসে পর্যন্ত আমার ওপর নজর রাখছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, খুনটা মোটেই আর হবে না!’
নিজেদের হতাশা ওরা গোপন রাখতে পারল না। অনিন্দ্যসুন্দর আবার হাসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘এগারোটার পরে দেবদূতের কাছে আমার আর কোনও বাধ্যবাধকতা থাকছে না। নিয়মিত ছকে তার নির্ধারিত সময়টা খুনি কাজে লাগাতে পারছে না, ফলে আমি বেঁচেই থাকব—বহু বছর বাঁচব। কিন্তু যেহেতু তোমাদের আসল পরিচয়টা এখন আমার কাছে স্পষ্ট, সেহেতু এই বাড়িতে আর একটা দিনও আমি থাকব না। দেখতেই পাচ্ছ, আমার সুটকেস গুছিয়ে নিয়েছি! এ-জায়গা ছেড়ে আমি চলে যাব দূরে—বহুদূরে। তারপর, কী-করে, তৃণা, তোমাকে, আর অভী, তোকে, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায়, সে-ব্যবস্থা আমি করছি। আর লেখক হিসেবে আমার ভবিষ্যতের কথা যদি তোল, তা হলে বলে রাখি, আজকের এই ঘটনা নিয়ে একটা নতুন বই লেখার কথা আমার মাথায় এসেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই কাহিনির অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য সুন্দর সান্যালের টলে যাওয়া আসনকে আবার নিজের জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। তুমি তোমার নিজের পথ বেছে নাও, কিংশুক। আর হীরা সিং, একজন দায়িত্বশীল আইন-মেনে-চলা নাগরিক হিসেবে আমাকে আমার কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।’
আরও একবার হাসলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
সন্দেহের ছায়ায় আবৃত পাঁচটি মানুষই নিস্পন্দ, নীরব। দেওয়াল-ঘড়িতে এগারোটা বাজতে ঠিক সাত মিনিট বাকি।
বৃদ্ধ হীরা সিংই প্রথম মুখ খুলল, ‘বন্দুক দেখিয়ে এইভাবে আমাদের দাঁড় করিয়ে রাখছেন, বড়েসাব? তা হলে ওই চাকু দিয়ে কোই ভি আপনাকে খুন করতে পারবে না। আপনি শেষ পর্যন্ত দেবতার সোঙ্গে বেইমানি করবেন?’
‘বেইমানি আমি করব না।’ শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘তোমাদের বন্দুক দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার নেই।’ নিজের বক্তব্য যেন প্রমাণ করতেই পিস্তলটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন তিনি: ‘আমার পরিকল্পনা অনেক সহজ-সরল, তাতে বন্দুক-ছুরির কোনও ব্যাপার নেই।’
‘সে-পরিকল্পনাটা কী আমরা জানতে পারি?’ কিংশুক দাবি করল।
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। এইতো আমি, নির্ধারিত জায়গায় নির্ধারিত সময়ে চুক্তিমতো বসে আছি। আর একইসঙ্গে, আমাকে যারা খুন করতে পারে, তাদেরও আমি এখানে হাজির করেছি। এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর কী হতে পারে?’
‘এর মধ্যে কোথাও একটা চালাকি আছে।’ তাঁর ভাইপো বলে উঠল।
‘থাকাই তো উচিত, অভী। তোদের পাঁচজনের একজন হচ্ছে খুনি। এবার খুনি মহোদয়, আপনার সামনে দুটো পথ খোলা আছে। ঠিক এগারোটায় আপনি ইচ্ছে করলে আমাকে খুন করতে পারেন—এই উজ্জ্বল আলোয়, আমাকে বাদ দিয়েও চার-চারজন সাক্ষীর সামনে। সেক্ষেত্রে পুলিশের হাতে আপনাকে ধরা পড়তেই হবে, কারণ আমি হলফ করে বলতে পারি, বাকি চারজন জঘন্য চরিত্রের মানুষ আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়ার জন্যে ভয়ঙ্কর ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু দ্বিতীয় একটা পথও আপনার আছে আমাকে খুন করার সুযোগটা আপনি ছেড়ে দিতে পারেন। সুতরাং আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে দায়ী হচ্ছেন আপনি নিজে, এবং সূর্যকান্তের সঙ্গে কোনওরকম বিশ্বাসঘাতকতা আমি করছি না। এগারোটা বেজে একমিনিটে এই বাড়ি ও তোমাদের জীবন ছেড়ে আমি চিরদিনের মতো চলে যাব।’
সশব্দে টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে নিয়ে স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘হ্যালো দেবদূতসাহেব—কী ব্যাপার?’
‘মিস্টার চৌধুরী, আপনি আমাকে ঠকাচ্ছেন! দেবদূত বলে উঠল।
‘উঁহু, মোটেই না। খুনিকে বের করার এটাই হচ্ছে একমাত্র পথ। খুনের আগে কোনও সূত্র পাওয়া সম্ভব নয়, এবং খুনের পরে আমি আর বেঁচে থাকছি না। যদি খুনি নিজে সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে আমাকে খুন করবে না, তা হলে আপনি আমাকে দোষ দিতে পারেন না।’
‘আপনি খুব চালাক, মিস্টার চৌধুরী!’
‘ধন্যবাদ।’
‘কিন্তু সেরকম চালাক নন। আপনি ভুলে যাচ্ছেন, রাত এগারোটায় খুনিকে একটা বিশেষ কাজ করতে হবে—আপনার মতো তাকেও সময় দেওয়া রয়েছে। সুতরাং তার একটা পালটা মতলব থাকতে পারে।’
টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। এ-কথা তিনি একবারও ভাবেননি। মনোযোগী দর্শকদের কাছে তাঁর টলে যাওয়া আত্মবিশ্বাস গোপন রইল না।