জিশান রিং-এর ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। ওর গায়ে গোলাপি-সাদা চেক কাটা হাফশার্ট। তার এখানে-সেখানে রক্ত লেগে রয়েছে—মালিকের রক্ত।
জিশান শার্টটা খুলতে শুরু করতেই মিহি গুঁড়োর মতো বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। শার্টটা খুলতে-খুলতে দর্শকদের ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল ও। আগ্রহে উত্তেজনায় ওরা কার্তিকের নাম ধরে চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে : ‘কার—তিক! কার—তিক! কার—তিক!’
কার্তিক রিং-এ পাক খেতে-খেতে জিশানের গায়ে থুতু ছিটিয়ে গেল। জিশান তাকিয়ে দেখল শুধু—কিছু বলল না।
রেফারি একটা হুইসল বাজাল। তারপর চেঁচিয়ে বলল, ‘স্টার্ট!’
ব্যস, লড়াই শুরু হয়ে গেল।
জিশান দু-পা ফাঁক করে সামনে ঝুঁকে দাঁড়াল—যেন এখনই শিকার লক্ষ্য করে লাফ দেবে। ওর ফরসা খালি গা, উজ্জ্বল চোখ, মাথার ঢেউ খেলানো চুল, রং-ওঠা জিনসের প্যান্ট, কোমরে কালো বেল্ট—দেখে মনে হয় না, ও ওল্ড সিটিতে থাকে।
আর কার্তিক! ওর ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, নিরীহ ভেড়ার ছানাদের রিং-এ টেনে এনে কুচিকুচি করে জবাই করাটাই ওর পেশা।
ও জিশানকে ঘিরে স্লো-মোশান ছবির মতো পাক খাচ্ছিল, আর তীক্ষ্ণ নজরে প্রতিপক্ষকে মেপে নিচ্ছিল। ও বেঁটে হলে কী হবে, হাফপ্যান্টের নীচেই ওর ঊরুর শক্তিশালী পেশি চোখে পড়ছিল। মিহি বৃষ্টিতে ওর মাথায়, গায়ে, বৃষ্টির কণা চিকচিক করছিল।
আচমকা জিশানের দিকে ছুটে এল কার্তিক। আফ্রিকার আদিবাসী যোদ্ধাদের মতো কানফাটানো এক জিগির তুলে শূন্যে লাফ দিল। ওর পেশিবহুল শক্ত ডান-পাটা টান-টান করে সামনে বাড়ানো। ও তাক করেছে জিশানের গলা। একবার সংঘর্ষ হলেই লড়াই খতম।
জিশান শূন্যে ধেয়ে আসা হিংস্র কার্তিককে দেখল। ওর মনে পড়ল, এ-খেলায় নিয়ম বলে কিছু নেই, বে-আইনি বলে কিছু নেই।
তাই পলকে এক হাঁটু ভাঁজ করে মাটিতে বসে পড়ল জিশান। কার্তিক তখন শূন্যে, ওর মাথার ওপরে।
কার্তিকের ঊরুসন্ধি লক্ষ করে লোহার মুঠি চালিয়ে দিল জিশান। সে-ঘুষির পিছনে ওর সমস্ত শক্তি একজোট করা ছিল।
কার্তিক সটান খসে পড়ল মাটিতে—যেন গুলি খাওয়া চড়ুইপাখি। আর বাজপাখি জিশান ছোঁ মেরে তুলে নিল ওর ছটফটে দেহটা। মাথার ওপরে তুলে এগিয়ে গেল লোহালক্কড়ের ডাঁইয়ের দিকে।
ওকে এগিয়ে আসতে দেখে দর্শকরা ভয়ে সরে গেল দুপাশে। কিন্তু ওরা পাগলের মতো চিৎকার করছিল, ‘জি—শান! জি—শান! জি—শান!’
জিশানের সামনেই জং-ধরা লোহার স্তূপ—খোঁচা-খোঁচা লোহার শিক বেরিয়ে আছে সেখান থেকে।
মালিকের কথা মনে পড়ল জিশানের। অন্ধ রাগে ও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, তারপরই কার্তিকের দেহটা ছুড়ে দিল লোহালক্কড়ের ওপরে।
জনতা উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল।
ব্যস, ফাইট খতম।
কার্তিককে উড়িয়ে দিয়েছে জিশান। মালিকের আত্মা নিশ্চয়ই দেখেছে, কে ফ্যালকন, আর কে স্প্যারো! জিশানের শপথ পূর্ণ হয়েছে। এবার জিশান জল খেতে পারে।
জিশান হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল রিং-এর জল-কাদার মধ্যে। হাঁ করে তাকাল ওপর দিকে।
বৃষ্টির ফোঁটা এখন মাপে একটু বড় হয়েছে। সেগুলো টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে জিশানের হাঁ করা মুখের ভেতরে। আকাশ থেকে ছেটানো শান্তির জল।
পাবলিক তখন রেফারিকে ঘিরে ধরেছে। হইচই চেঁচামেচি হচ্ছে। আপসেট রেজাল্টে বেশিরভাগেরই মুখ ব্যাজার। যারা জিতেছে তাদের মুখে চওড়া হাসি। কেউ-কেউ চেঁচিয়ে গান ধরেছে।
ভেজা গায়ে উঠে দাঁড়াল জিশান। রিং-এর একপাশে পড়ে থাকা দলাপাকানো ভেজা শার্টটা তুলে নিয়ে গায়ে দিল। তারপর বোতাম লাগাতে-লাগাাতে রেফারির কাছে গেল। আড়চোখে লক্ষ করল, কার্তিকের দেহ অথবা মৃতদেহ ঘিরে বেশ বড়সড় জটলা তৈরি হয়ে গেছে।
ভীষণ আপসেট রেজাল্ট—এ-রেজাল্ট কেউ ভাবতেও পারেনি। তাই জিশানের হাতে অনেকগুলো টাকা ধরিয়ে দিল রেফারি। তারপর মিহি গলায় বলল, ‘পরশু রাতে আবার ফাইট আছে। জরুর আসবে—সেদিন তোমার হয়ে মোটা মাল লড়িয়ে দেব…।’
টাকাগুলো নেওয়ার সময় জিশানের ডানহাতটা ব্যথা করছিল। ঘুষিটা কার্তিককে ও এত জোরে মেরেছে যে, এখনও কাঁধ পর্যন্ত টনটন করছে। কিন্তু ওইটুকু ব্যথা নিয়েও অনায়াসে এই রেফারি লোকটাকে একটা থাপ্পড় মারা যায়। কারণ, খানিকক্ষণ আগে এই লোকটাই জিশানকে কুকুরের মতো লাথি মেরেছিল।
যে-এলাকার যা নিয়ম।
জিশান প্রথমে রেফারির মুখে শব্দ করে থুতু দিল। তারপর সপাটে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিল লোকটার গালে।
পটকা ফাটার মতো শব্দ হল এবং লোকটা চোখ উলটে ভিড়ের গায়ে ঢলে পড়ল।
জিশান আর দাঁড়াল না। দর্শকদের ভিড় ঠেলে খালপাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল। ততক্ষণে বৃষ্টি আরও বেড়ে গেছে। কাদায় ওর পা পিছলে যেতে চাইছিল বারবার।
রাস্তায় উঠে এসে তাড়াতাড়ি পা চালাল জিশান। অনেক দেরি হয়ে গেছে মিনি চিন্তা করবে। কিন্তু একটা কথা ভেবে ওর ভালো লাগছিল—পকেটে এখন অনেকগুলো টাকা। শানুর জন্য একটা কেন, ও এখন চাইলে দশটা দুধ কিনতে পারে।
ওষুধের দোকানের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎই কান্না পেয়ে গেল জিশানের। প্রথমে মালিকের জন্য। ও ভাবতেই পারছিল না, ওকে আর কেউ ‘জিশু’ বলে ডাকবে না। বিশৃঙ্খল এই শহরে উচ্ছৃঙ্খল জীবন কাটানোর জন্য কেউ তাকে আর বারবার করে লোভ দেখাবে না। ভাবতেই পারছিল না, মালিক আর নেই।