নিউ সিটির সুপারগেমস কর্পোরেশনের ওপরে ভীষণ রাগ হল জিশানের। ওদের বিপজ্জনক খেলাগুলোয় সবসময় নাম দেয় ওল্ড সিটির লোকজন—যারা চট করে বড়লোক হতে চায়, যাদের জানের এমনিতে খুব একটা দাম নেই।
আর নিউ সিটির বড়লোকগুলো! এক-একটা সব ভিতুর ডিম! একটা গেম শো-তেও ওরা কেউ নাম দেয় না। ওরা শুধু বাড়িতে নিশ্চিন্তে বসে প্লেট টিভিতে খেলা দ্যাখে আর চিকেন-প্রন পকোড়ার সঙ্গে সুস্বাদু পানীয় খায়।
গেম শো-গুলোকে জনপ্রিয় করার জন্যই ‘সিন্ডিকেট’ অসংখ্য প্লেট টিভি বিনা পয়সায় লাগিয়ে দিয়েছে ওল্ড সিটিতে। টিভির ইন্টারঅ্যাক্টিভ প্রাোগ্রামে স্রেফ বোতাম টিপেই গেম শো-তে নাম দেওয়া যায়।
সেই গেম শো নকল করতে পাগল ওল্ড সিটি। নকল নবিশির জেরে শেষ হয়ে গেল মালিক। এর হিসেব সমান করবে কে? জিশান?
গেম শো নিয়ে ঘৃণা আর টানের ফাঁদে পড়ে গেল জিশান। ওর চোখ ফেটে জল বেরোচ্ছিল।
মালিকের শরীরের ওপরে ঝুঁকে পড়েছিল ও। হঠাৎই টের পেল, মালিকের শ্বাস পড়ছে। চোখের জল মুছে ও ‘মালিক!’ বলে ডেকে উঠল। ওর মুখের ওপরে আরও ঝুঁকে পড়ল।
মালিক ধীরে-ধীরে চোখ খুলে জিশানকে দেখল। অনেকক্ষণ ঘোলাটে নজরে তাকিয়ে থেকে তারপর খুব অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করে বলল, ‘জিশু, ভেবেছিলাম লড়ব যখন ফ্যালকনের মতো লড়ব…কিন্তু সালা স্প্যারোর মতো লড়লাম। তুই ওকে উড়িয়ে দে। ওই কার্তিক সালাকে না উড়িয়ে তুই জল খাবি না। গড প্রমিস!’
মালিকের চোখ বুজে গেল। আর শ্বাস পড়ছে কিনা ঠিক বোঝা গেল না। আশেপাশে ভিড় করে থাকা লোকজন এতক্ষণ ‘হাসপাতাল…ডাক্তার…’ এসব বলছিল। ওরা হঠাৎই চুপ করে গেল। কে একজন চিৎকার করে বলল, ‘সালা টেঁসে গেছে। বডিটা খালাস করে দে।’
সঙ্গে-সঙ্গে দু-তিনজন লোক এসে মালিকের বডিটা টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল।
জিশান প্রথমটা আটকাতে গিয়েছিল—কিন্তু কী ভেবে ছেড়ে দিল। কী হবে মালিকের বডি নিয়ে? বডি নিয়ে কোথায় যাবে ও? শ্মশানে ছাড়া?
জিশানের হাতে-জামায় রক্ত। নাকে মালিকের গায়ের গন্ধ টের পাচ্ছিল ও—বন্ধুত্বের গন্ধ।
ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল জিশান। ঠিক তখনই একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ওর সামনে বাড়িয়ে ধরল কেউ।
মুখ তুলে তাকাল জিশান। ওর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে রেফারি। মালিকের হেরে যাওয়ার টাকাটা জিশানকে দিচ্ছে।
জিশানের বমি পেয়ে গেল। মুখে একগাদা থুতু উঠে এল পলকে।
টাকাটা জিশান নিতে চায়নি, কিন্তু হঠাৎই ওর মনে হল, ওটা মালিকের স্মৃতি। তা ছাড়া মালিক মারা যাওয়ার আগে ফিসফিস করে যা বলে গেছে সেই কথাগুলো এখন দামামা হয়ে জিশানের কানে বাজছে: ‘…কার্তিক সালাকে না উড়িয়ে তুই জল খাবি না। গড প্রমিস।’
মালিকের পাওনা টাকা আর পাওনা শপথের দায় এখন জিশানের।
জিশান আকাশের দিকে একবার মুখ তুলে তাকাল। ও ভালো করেই জানে, ওখানে গড বলে কেউ নেই—সেইজন্যেই আকাশটা দিনের বেলায় ফাঁকা আর রাতের বেলা অন্ধকার—এই নষ্ট শহরটার মতো অন্ধকার।
রঙিন ধূমকেতু দুটোর লাল-নীল আভা জিশানের চোখে পড়ল। ও মালিককে যেন আকাশে দেখতে পেল কোথায়। চোখ মুছে নজর নামাল জিশান। পঞ্চাশ টাকার নোটটা নিল রেফারির কাছ থেকে। লোকটার সারা গা থেকে বিড়ির গন্ধ বেরোচ্ছিল, তার সঙ্গে বোটকা গন্ধ।
জিশান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আর-একটা ফাইট হয়ে যাক। ওই কার্তিকের সঙ্গে আমি লড়ব।’
সঙ্গে-সঙ্গে রেফারির দু-চোখে ফস করে খুশির আলো জ্বলে উঠল। ডানহাত ওপরে তুলে লোকটা মিহি গলায় চেঁচাতে শুরু করল, ‘কেউ চলে যেয়ো না। শুরু হচ্ছে নয়া ফাইট। কার্তিকের সঙ্গে লড়বে নতুন আনকোরা এক ইয়ং ফাইটার—’ লোকটা চেঁচানো থামিয়ে নিচু গলায় জিশানকে জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম কী?’
‘জিশান।’
‘বন্ধুগণ, নতুন ফাইটার জিশান—আর আমাদের চ্যাম্পিয়ন কার্তিক।’ আবার চেঁচানি শুরু হয়ে গেল : ‘এটাই আজকের লাস্ট ফাইট। আজকের মারাত্মক লাস্ট ফাইট। জিশান ভার্সেস কার্তিক—দেখা যাক সালা কে জেতে—।’
চেঁচাতে-চেঁচাতে লোকটা চলে গেল ওর টুলের কাছে। প্রায় লাফিয়ে টুলের ওপরে উঠে দাঁড়াল। আর সঙ্গে-সঙ্গে দর্শকরা ওর দিকে হামলে পড়ল। নানান প্রশ্ন করতে লাগল।
‘একে বিশ, একে বিশ! জলদি করো! লাস্ট ফাইট—ঢিসুম-ঢিসুম—কাম অন, কাম অন…।’
মালিকের সঙ্গে লড়াই শেষ হওয়ার পর জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা করছিল অনেকে। অনেকে আবার বাড়ির পথ ধরেছিল। মালিকের মারা যাওয়ার ব্যাপারটা ওদের মনে তেমন দাগ কাটেনি। কারণ, এই ফাইট গেমে মাঝে-মাঝেই দু-একজন মারা-টারা যায়। এই গেমে যে ঝুঁকি আছে সেটা সবাই জানে। আর ঝুঁকি আছে বলেই খেলাটায় এত রোমাঞ্চ, এত উত্তেজনা।
রেফারির চিৎকার শুনে দর্শকদের ভাব-ভঙ্গি পালটে গিয়েছিল। শান্ত হয়ে যাওয়া মানুষগুলো আবার যেন রক্তের খিদেয় পাগল হয়ে গেল। ছত্রখান জনতা চটপট নিজেদের গোল করে সাজিয়ে নিল—মাঝে জল-কাদা মাখা এবড়োখেবড়ো রিং। জনতার অনেকেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল রেফারির কাছে—ওকে মাছির মতো ছেঁকে ধরল। রেফারিও চটপট পেশাদারি ঢঙে বাড়িয়ে ধরা হাতগুলো থেকে ছোঁ মেরে টাকা নিয়ে ছোট-ছোট স্লিপ গুঁজে দিতে লাগল।
রিং-এর ভেতরে কার্তিক ততক্ষণে হিংস্র উল্লাসে লাফাতে শুরু করেছে। বড়-বড় লাফ দিয়ে দর্শকদের নাকের ডগা ছুঁয়ে গোল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে গালাগালির ফোয়ারা।