কিন্তু কার্তিক পেশাদার ফাইটার। এ-লাইনে পুরোনো পাপী। তাই মালিক গলা টিপে ধরতেই ও ডান হাঁটু দিয়ে মালিকের দু-ঊরুর মাঝে এক জোরালো গুঁতো মারল। সঙ্গে-সঙ্গে হেঁচকি তোলার শব্দ করে মালিক মাটিতে খসে পড়ল, শরীরটাকে কেন্নোর মতো গুটিয়ে কাটা ছাগলের মতো ছটফট করতে লাগল।
জিশান চিৎকার করে উঠেছিল, ‘কী হচ্ছে কী? এখনই লড়াই বন্ধ করো। এভাবে যেখানে-সেখানে মারার নিয়ম নেই। বন্ধ করো ফাইট।’
দর্শকরা জিশানের কথা কানেই তুলল না। রক্ত দেখার খিদেয় জন্তুর মতো চিৎকার করতে লাগল। কে একজন বলল, ‘ফাইটের মাঝে আবার নিয়ম দেখাচ্ছ! ব্যাটা বুরবাক!’
জিশান দু-হাতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে চাইল রেফারির কাছে। ধাক্কাধাক্কিতে একটা মশাল থেকে আগুনের কুচি ছিটকে পড়ল ওর গলার কাছে। পিন ফোটানোর মতো যন্ত্রণা হল। ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন গালাগাল দিল জিশানকে।
কোনওরকমে টুলে দাঁড়ানো রেফারির কাছে এসে পৌঁছল ও। লোকটা গভীর মনোযোগে মালিক আর কার্তিকের লড়াই দেখছে, একইসঙ্গে ফুকফুক করে বিড়ি টানছে।
জিশান চেঁচিয়ে অনেক কিছু বলছিল, কিন্তু লোকটা সেদিকে কোনও কানই দিচ্ছিল না।
রেফারির গায়ের তেলচিটে নোংরা পোশাকের বোটকা গন্ধ জিশানের নাকে আসছিল। ছুঁতে ঘেন্না করলেও শেষ পর্যন্ত ও মনের জোরে লোকটার প্যান্ট ধরে টান মারল। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘এভাবে যেখানে-সেখানে মারার কোনও নিয়ম নেই—।’
লোকটা বিরক্ত হয়ে চোখ নামিয়ে তাকাল জিশানের দিকে। চোখের পলকে কুকুর-তাড়ানোর ভঙ্গিতে একটা লাথি চালাল জিশানের বুকে এবং দাঁত বের করে খিঁচিয়ে উঠল, ‘ফোট, সালা—ফোট! এ-ফাইটে ইল্লিগাল বলে কিছু নেই।’
তারপরই আবার খেলা দেখায় মন দিল।
জিশান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন দর্শক অশ্রাব্য গালিগালাজ করে ওকে ঠেলে সরিয়ে দিল সামনে থেকে।
লাথি-খাওয়া কুকুরের মতো সরে এল জিশান। ভিড় ঠেলে উঁকি মারল রিং-এর ভেতরে।
মালিকের অবস্থা তখন ভালো নয়। ওকে উপুড় করে একটা পা মুচড়ে ধরেছে কার্তিক। মালিকের অন্য পা-টা শূন্যে ছটফট করছে। সেই অবস্থায় কার্তিক কনুই দিয়ে মালিকের পিঠে গুঁতো মারছিল।
মালিক অতিকষ্টে পালটি খেল। কোনওরকমে জোড়া পায়ে ঝটকা দিয়ে ঠেলে দিল কার্তিককে। তারপর ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল।
জিশান দেখল, মালিকের ঠোঁটের কোণ আর কপাল থেকে রক্ত পড়ছে। ওর গায়ের রং কালো বলে ব্যাপারটা খুব স্পষ্টভাবে চোখে পড়ছে না। তবে জ্বলন্ত মশালের আগুনের আভায় গড়িয়ে পড়া রক্ত চকচক করছে।
জিশান বুঝতে পারছিল মালিকের হয়ে এসেছে। ও চিৎকার করে ডেকে উঠল, ‘মালিক! বেরিয়ে আয়—আর ফাইট করতে হবে না! চলে আয়…! মালিক! চলে আয়—!’
জিশানের গলার আওয়াজ পেয়ে মালিক সেদিক লক্ষ করে তাকাল। আলো-ছায়ার খেলার মাঝে জিশানকে খুঁজে নিতে চাইল।
মালিক একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। সেইজন্যই ছুটে আসা কার্তিককে ও খেয়াল করেনি। যখন করল তখন দেরি হয়ে গেছে।
বুলেটের মতো ছুটে এসে কার্তিক মাথা দিয়ে গুঁতো মারল মালিকের পেটে। বুনো ষাঁড়ের মতো ওর শরীরটাকে ঠেলে নিয়ে চলল রিং-এর ধারে দাঁড়ানো দর্শকদের দিকে।
প্রচণ্ড উত্তেজনার চিৎকার শোনা গেল। হুড়মুড়িয়ে দর্শকরা সরে গেল জায়গা থেকে—যাতে ফাইটারদের সঙ্গে সংঘর্ষ না হয়। আর তখনই রিং-এর বাইরে লোহালক্কড়ের ডাঁইটা নজরে পড়ল জিশানের। এতক্ষণ দর্শকদের ভিড়ে ওগুলো আড়াল হয়ে ছিল।
জিশান আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। ওর চোখ বড়-বড় হয়ে উঠল। আর সেই বিস্ফারিত চোখের সামনেই মালিকের শরীরটা জং-ধরা লোহালক্কড়ের স্তূপে গিয়ে ধাক্কা খেল।
ঠিক কী যে হল ভালো করে বোঝা গেল না। বোঝা গেল একটু পরে—কার্তিক যখন সরে এল মালিকের কাছ থেকে।
মালিকের দেহটা তখনও বলতে গেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু চোখ বোজা। মাথাটা ঝুঁকে পড়ে চিবুকটা প্রায় বুকে ঠেকে গেছে।
কার্তিক তখন রিং-এর মধ্যে নৃশংস উল্লাসে নেচে বেড়াচ্ছে। ওর দেহের দু-চার জায়গা কেটে-ছড়ে গেলেও ও বিন্দুমাত্রও কাহিল হয়ে পড়েনি।
চারপাশে দর্শকদের হইচই চলছে। রিং-এর মধ্যে অনেকে ঢুকে পড়েছে। রেফারি সরু গলায় ‘কার্তিক! কার্তিক!’ বলে চেঁচাচ্ছে। সেই তালে-তালে দর্শকও চেঁচাচ্ছে, ‘কার—তিক! কার—তিক!’
জিশান ছুটে গেল মালিকের কাছে। আর কাছাকাছি এসেই ওর মনে হল, মালিক বোধহয় আর বেঁচে নেই। হঠাৎই ত্রুশবিদ্ধ জিশুর ছবিটা ঝলসে উঠল ওর চোখের সামনে। ও হাত বাড়িয়ে মালিককে জড়িয়ে ধরল, টান মেরে তুলে নিতে চাইল বুকে, কিন্তু ওকে নড়াতে পারছিল না।
জিশান কেঁদে ফেলেছিল। বারবার মালিকের নাম ধরে ডাকছিল। তখন কয়েকজন দর্শক আর রেফারি মিলে জিশানের সঙ্গে হাত লাগাল। পিঠে গেঁথে যাওয়া লোহাগুলো অনেক কষ্টে ছাড়িয়ে মালিককে বের করে নিয়ে এল ওরা। মালিকের শরীরের পিছনদিকটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
জিশান ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। একহাজার টাকার জন্য এভাবে ঝুঁকি নিল মালিক!
কিন্তু মালিক তো ঝুঁকি নিতে চায়নি! উত্তেজনায় পাগল দর্শকের দল ওকে ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে দিয়েছে রিং-এর ভেতরে। প্লেট টিভির গেম শো-গুলোই সবার সর্বনাশ করেছে। রোজ-রোজ নতুন-নতুন গেম চালু হচ্ছে টিভিতে। কী করে পলকে বড়লোক হওয়া যায়—এই চিন্তাটাই ঢুকে গেছে সবার মনের ভেতরে।