একটা ভোঁতা শব্দ হল। তারপরই ছুন্না চিৎ হয়ে পড়ে গেল। আর কার্তিক শরীরটাকে গড়িয়ে ওর কাছে নিয়ে গেল। একখাবলা মাটি তুলে নিয়ে ঘুঁটে দেওয়ার মতো ঢঙে সজোরে থাবড়ে দিল ছুন্নার মুখে। এবং পলকে উঠে দাঁড়িয়ে ছুন্নার একটা পা একটানে তুলে নিল। সেটাকে গোড়ালি ধরে মুচড়ে শরীরটাকে বাঁকিয়ে চাপ দিতে লাগল। আর ছুন্না অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করতে লাগল।
বোঝা গেল, লড়াই শেষ।
দর্শক উল্লাসে জিগির তুলতে লাগল : ‘কার—তিক! কার—তিক! কার—তিক!’
মালিক জিশানের কানে ফিসফিস করে বলল, ‘সালা আমার তিরিশটা টাকা গেল।’
জিশান অবাক হয়ে মালিকের দিকে তাকাল। ও কখন ছুন্নার ওপরে বাজি ধরেছে কে জানে!
‘তুই কখন টাকা লাগালি?’
‘এখানে এসেই—।’
‘এভাবে যখন-তখন বাজি ধরা যায়?’
‘যায়। সেটা অ্যালাউ করবে কি না ঠিক করে রেফারি—ওই যে, ওই টিংটিঙে লোকটা—যে নোটের গোছা হাতে চেঁচাচ্ছে।’
রেফারি তখন বাজি জেতা লোকজনকে টাকা দিচ্ছে। কার্তিক আর ছুন্না একবালতি জল থেকে আঁজলা করে জল নিয়ে রক্ত আর কাদা ধুয়ে নিচ্ছে। দু-তিনটে ছেলে ওদের সাহায্য করছে।
মিনিটপাঁচেক পরেই রেফারি আবার হাঁকতে শুরু করল : ‘এবার পরের ফাইট। সব সরে যাও—এবার শুরু হবে পরের ফাইট। কে লড়বে বলো—কে লড়বে?’
জনতার মধ্যে তখন চাপা উত্তেজনা, জোর আলোচনা চলছে, কথাকাটাকাটিও হচ্ছে। কেউ বলছে, ছুন্নার মুখে কাদা লেপটে না দিলে কার্তিক মোটেই জিততে পারত না। আবার কেউ-বা বলছে, কার্তিকের গায়ে অসম্ভব জোর—আর প্রতিপক্ষের মার সহ্য করার ক্ষমতাও সাংঘাতিক।
রিং-এ কেউ ছিল না। হঠাৎই কার্তিক লাফিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। তারপর বক্সার কিংবা কুস্তিগিরদের ঢঙে নেচে-নেচে ঘুরে বেড়াতে লাগল। আর রেফারি তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, ‘বন্ধুগণ, দোস্তোঁ, মাই ফ্রেন্ডস—কার্তিক আবার লড়তে রাজি আছে। আমাদের ফেবারিট ফাইটার কার্তিক। কে লড়বে ওর সঙ্গে? কে লড়বে? একজনও হিম্মৎদার ব্যাটাছেলে এখানে নেই? একটাও সালা বাপের ব্যাটা নেই?’
রেফারির চেঁচানি চলছিল, আর জনতার গুঞ্জনও চলছিল সমান তালে। মশাল, হ্যারিকেন আর কুপির আলোয় এ ওর দিকে তাকাচ্ছিল—চোখে প্রশ্ন : পয়সার লোভে কে কার্তিকের সঙ্গে লড়ার ঝুঁকি নেবে?
রেফারি তখন বুঝেছে বাজির দর না বাড়ালে কাউকে পাওয়া যাবে না। অথচ আর-একটা লড়াই হলে তার কমিশনটাও বাড়বে। তা ছাড়া এই ছন্নছাড়া গরিব মানুষগুলোর কাছে পয়সা বিরাট ব্যাপার। সুতরাং সে বাজির দর চড়াতে লাগল। বলতে লাগল, নতুন ফাইটার জিতলে একটাকায় ছ’টাকা। আর ফাইটারকে দেওয়া হবে একহাজার টাকা। ফাইটার যদি হেরে যায়, তা হলে পাবে মাত্র পঞ্চাশ টাকা।
জিতলে একহাজার টাকা!
শ্বাস টানল মালিক। চাপা গলায় জিশানকে বলল, ‘একহাজার টাকা মাইরি অনেক। লড়ে গেলে হয়।’
জিশান অবাক হয়ে তাকাল বন্ধুর দিকে। কী বলছে মালিক! কার্তিক পেশাদার ফাইটার—মালিক তার সঙ্গে কী করে পেরে উঠবে? মালিকের প্লাস পয়েন্ট একটাই—ওর জন্য চোখের জল ফেলার কেউ নেই। একমাত্র জিশান ছাড়া।
মালিক দিন-রাত এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়, নানান ফুর্তি-ফার্তা করে, টাকা ওড়ায়। গুছিয়ে বাঁচার ইচ্ছেটা ওর মধ্যে একদম নেই। ওর নীতি হচ্ছে, রঙ্গরৌলি করে জিন্দেগি কাটাও। কিন্তু তাই বলে কার্তিকের সঙ্গে ফাইট!
জিশান বলল, ‘তুই কি খেপেছিস?’
‘কিন্তু জিশু, ভেবে দেখ, একহাজার টাকা! একবার রিসক নিলে হয়…।’
‘ধুৎ, তুই কার্তিকের সঙ্গে পারবি না—।’
‘পারতেও তো পারি!’
আশপাশের কয়েকজন দর্শক ওদের কথাবার্তা শুনছিল। তাদেরই একজন বলে উঠল, ‘লড়ে যাও। তোমার তো দারুণ বডি!’
আর-একজন বলল, ‘শুনলে না, জিততে পারলে হাজার টাকা। ঢুকে পড়ো, রিং-এ ঢুকে পড়ো।’
আচমকা দুজন লোক মালিকের একটা হাত ধরে শূন্যে তুলে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এ লড়বে! এ লড়বে!’
ব্যস, সঙ্গে-সঙ্গে তুলকালাম ঘটে গেল।
টুলে দাঁড়ানো রেফারির কাছে পটাপট বাজির টাকা জমা পড়তে লাগল। জনতা নতুন লড়াই দেখার আশায় হইহই করে উঠল।
মালিক একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল—কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। আর জিশান লোকদুটোর হাত থেকে মালিককে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। বারবার বলতে লাগল, ‘ও লড়বে না। ও লড়বে না।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা! কয়েকটা হাত প্রবল ধাক্কায় মালিককে ছিটকে দিল রিং-এর ভেতরে। মালিক চিতপাত হয়ে পড়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে রেফারি একটা হুইসল বাজিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘স্টার্ট!’ আর হিংস্রভাবে নেচে বেড়ানো কার্তিক চুলের মুঠি ধরে মালিককে একটানে তুলে নিল। কয়েকপলক তাকাল গোল হয়ে ঘিরে থাকা দর্শকদের দিকে। তারপর এক ভয়ঙ্কর চাপড় বসিয়ে দিল মালিকের গালে—কিন্তু ওর চুলের মুঠি ছাড়ল না।
মালিকের মুন্ডুটা প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে গেল। অসহ্য ব্যথায় মনে হল চোয়ালটা বোধহয় এখনই খুলে পড়বে। কয়েক লহমার জন্য অসাড় হয়ে গেল মালিক। ওর চোখ বুজে গেল।
কিন্তু প্রতিবর্তী ক্রিয়া বলে একটা ব্যাপার আছে। বাঁচার তাগিদ কারও কিছু কম নেই। আত্মরক্ষার তাগিদও। হয়তো সেই তাগিদেই অনেকটা অটোমেটিক পুতুলের মতো কার্তিকের গলা টিপে ধরল মালিক। নদীতে ডুবে যাওয়ার সময় মানুষ যেরকম প্রাণপণে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে, অনেকটা সেই ঢঙে মালিক কার্তিকের গলা টিপে ধরেছিল—যেন বাঁধন আলগা করলেই ও জলে ডুবে মারা যাবে।