শুটারগুলো যখন হর্ন দেয় তখন মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। ওদের হর্নের তীব্র শিসের মতো শব্দ কখনও-কখনও জানলার কাচও ভেঙে দেয়। শিস দিয়ে ওরা ওল্ড সিটির লোকজনকে সাবধান করে দেয়। বিপজ্জনক ভিড় বা জটলা থাকলে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আর শিসে কাজ না হলে বুলেট চলে—কখনও রবার-বুলেট, কখনও মেটাল-বুলেট।
হাঁটতে-হাঁটতে মানিকতলার খালের কাছে পৌঁছে গেল মালিক আর জিশান। পথে নানান জায়গায় দেখল, মানুষজন ভিড় করে প্লেট টিভিতে গেম শো দেখছে। নানান কোম্পানি নানারকম গেম শো দেখালেও সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেমগুলোই সবার সেরা।
সে-কথাই মালিককে বলছিল জিশান।
মালিক তাতে হেসে বলল, ‘ওল্ড সিটির ফাইট গেমটাও কিছু কম নয়। গেমটা একবার দেখ—নেশা ধরে যাবে।’
কথা বলতে-বলতে হাসি-ঠাট্টা করতে-করতে একটা বিশাল কারখানার সামনে হাজির হল ওরা।
কারখানাটা উঠে গেছে বহুকাল। এককালে স’ মিল ছিল—এখন তার ভাঙাচোরা কঙ্কাল পড়ে আছে। তার ভেতরে আলো-আঁধারিতে ঝুপড়ি বেঁধে আস্তানা গেড়েছে অসংখ্য লোক।
স’ মিলের সামনের রাস্তায় পাইপ ফেটে ফিনকি দিয়ে জল বেরোচ্ছে। বাচ্চাকাচ্চা কোলে নিয়ে কয়েকজন মহিলা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছে। চার-পাঁচটা উনুন থেকে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে পাক খেয়ে উঠে যাচ্ছে লাল-নীল ধূমকেতুর দিকে।
স’ মিলের অন্ধকার থেকে একটা মোটাসোটা ধেড়ে ইঁদুর বেরিয়ে এল। তারপর বেশ ধীরে-সুস্থে হেলেদুলে রাস্তা পার হয়ে চলে গেল খালের দিকে।
একটা হইহই চিৎকার ওদের কানে আসছিল। আঙুল তুলে স’ মিলের উলটোদিকের খালধারটা দেখাল মালিক, বলল, ‘খালপাড়ে…নীচেটায়…ফাইট হচ্ছে। জলদি চল।’
খালধারে অনেকটা জায়গা জুড়ে ঘন আগাছা—মাঝে-মাঝে বড়-বড় গাছ। কোনও-কোনও গাছের তলায় ফেলে যাওয়া শীতলা ঠাকুর। রোদ-জল-বৃষ্টিতে ঠাকুরের হতমান অবস্থা।
ওরকমই একটা ঠাকুরের পাশে প্রচুর লোহালক্করের ডাঁই। তার মধ্যে গোটাপাঁচেক জং-ধরা ভাঙা গাড়িও আছে। একটা গাড়ির মাথায় আর-একটা গাড়ি চড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তার পাশ দিয়ে এগিয়ে ঢাল বেয়ে খালের দিকে নামতে শুরু করল মালিক। জিশান ওর পিছু নিল।
একটা বড় গাছ পেরোতেই ঢালুভাবে নেমে যাওয়া খালপাড়টা জিশানের চোখে পড়ল। খালপাড়ের ঢালে—বেশ খানিকটা নীচে—একটা এবড়োখেবড়ো সমতল জায়গা। সেখানে আগাছার জঙ্গল সাফ করে ময়দান-এ-জঙ্গ তৈরি হয়েছে। তাকে ঘিরে অসংখ্য কেরোসিন কুপি, হ্যারিকেন আর মশালের আলো। ঠিক যেন মনে হচ্ছে দেওয়ালির রাত। আর সেই আলোর বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে বেশকিছু দর্শক উত্তেজনায় চিৎকার করছে : ‘খতম করো! খতম করো!’
লড়াইয়ের রিং-টা খালপাড়ের ঢালে বেশ খানিকটা নীচে হওয়ায় রাস্তা থেকে চোখে পড়ার উপায় নেই। ফলে এখন ওটা নজরে আসামাত্রই জিশান বুকে একটা ধাক্কা খেল।
রিং-এর ভেতরে তখন লড়াই চলছে।
•
জিশান এই ফাইট গেমের কথা আগে শুনেছে, কিন্তু কখনও দেখেনি। তাই ও অবাক হয়ে দেখছিল।
একটা কদমছাঁট চুল লম্বা ছেলে একজন বেঁটেমতন লোকের সঙ্গে লড়ছিল।
ছেলেটার গায়ের রং ময়লা, এককানে মাকড়ি, গলায় কালো সুতোর মালায় একটা চকচকে লকেট ঝুলছে। ওর পোশাক বলতে একটা বাদামি রঙের হাতকাটা ফতুয়া, আর ছেঁড়া জিনসের প্যান্ট।
বেঁটেমতন লোকটার গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, আর একটা কালচে হাফপ্যান্ট। মাথায় বড়-বড় চুল। কুতকুতে চোখ।
লড়াই চলছিল আর একটা টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে একজন রোগা-সোগা লোক মিহি গলায় ফিরিওয়ালার মতো চেঁচাচ্ছিল : ‘ফাইট দারুণ জমে উঠেছে। দেখা যাক, কে জেতে—কার্তিক, না ছুন্না। একে চার, একে চার…।’
ফিরিওয়ালা লোকটার হাতে অনেকগুলো নোট। মুঠো করে ধরে বাতাসে নাড়ছে। কেউ-কেউ হাত বাড়িয়ে তার হাতে টাকা দিচ্ছে। লোকটা টাকা নিয়ে একটা ছোট স্লিপমতন দিচ্ছে।
টাকাগুলো দেখে জিশানের তেষ্টা পেয়ে গেল, শানুর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ে গেল, কিছুক্ষণ আগে ওর পকেটের টাকাগুলো কেউ হাতিয়ে নিয়েছে।
হ্যারিকেন, কুপি, আর মশালের লাল-হলদে শিখা কাঁপছিল। সেই আলো ছিটকে পড়েছে দর্শকদের উল্লাস ভরা মুখে, লড়াকু কার্তিক আর ছুন্নার গায়ে।
আশপাশের লোকজনকে জিগ্যেস করে মালিক জানতে পারল, বেঁটেমতন ফাইটার হচ্ছে কার্তিক, আর জিনস পরা ছেলেটা ছুন্না। কার্তিক আগে অনেক ম্যাচ জিতেছে। সেই তুলনায় ছুন্না একেবারেই নতুন—শুধু আগের ম্যাচটা জিতেছে। সুতরাং ছুন্নার ওপরে যারা বাজি ধরেছে, ছুন্না জিতলে তারা একটাকায় চারটাকা পাবে। আর কার্তিক জিতলে দশটাকায় তিনটাকা।
রিং-এর ভেতরটা সাফসুতরো করা হলেও জমি এবড়োখেবড়ো, কোথাও-কোথাও কাদা রয়েছে। তারই মধ্যে ছুন্না আর কার্তিক জন্তুর মতো লড়ছিল। ছুন্নার পা চলছিল বেশি, আর কার্তিকের হাত। আর দুজনেই মাঝে-মাঝে বিশ্রী ভাষায় একে অপরকে গালিগালাজ করছিল।
ছুন্না মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। সেই অবস্থাতেই কার্তিকের তলপেটে এক লাথি কষিয়ে দিল। ‘ওঁক’ শব্দ করে উঠল কার্তিক, ওর শরীরটা ভাঁজ হয়ে ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে। ছুন্না বেজির ক্ষিপ্রতায় লাফিয়ে উঠে খামচে ধরল কার্তিকের চুল—এক প্রবল হ্যাঁচকা টানে ওকে ছিটকে ফেলে দিল চারহাত দূরে। তারপরই ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর গায়ের ওপর। সঙ্গে-সঙ্গে কার্তিক সপাটে এক ঘুষি কষিয়ে দিল ছুন্নার মুখে।