যেমন, ‘স্নেকস অ্যান্ড জেমস’ নামের একটা খেলায় সাপের চৌবাচ্চায় নেমে জলে হাতড়ে ছড়ানো-ছিটানো হিরের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে আসতে হয়। চৌবাচ্চায় ফুটখানেক ঘোলা জল। তার মধ্যে কিলবিল করছে বিষধর সাপ। আর জলের তলায় ছড়িয়ে আছে ছোট-বড় নানান মাপের হিরে। যে-ক’টা হিরে নিয়ে যে বেঁচে উঠে আসবে সেগুলো তার। যদি সেই প্রতিযোগী হিরেগুলো বিক্রি করতে চায় তা হলে ‘সুপারগেমস কর্পোরেশন’ টাকা দিয়ে সেগুলো কিনে নেয়।
আর-একটা খেলার নাম ‘ম্যানিম্যাল রেস’। ম্যান আর অ্যানিম্যাল—দুটো শব্দ জুড়ে তৈরি হয়েছে ম্যানিম্যাল। এই দৌড়ে অংশ নেয় কয়েকজন মানুষ আর একপাল তাগড়া বুনো কুকুর। এই দৌড়ে শুধু ফার্স্ট হলেই চলবে না, গায়ে কুকুরের আঁচড়-কামড়ের চিহ্ন থাকা চাই। তবেই পাওয়া যাবে পুরস্কার। দু-লক্ষ টাকা।
প্রাইজ মানির অঙ্কটা শুনলেই জিশানের বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। কতবার যে ও স্বপ্নে দেখেছে, ও খেলায় জিতে পুরস্কার নিচ্ছে, আর মিনি শানুকে কোলে নিয়ে তার লাইভ টেলিকাস্ট দেখছে! তারপর থেকে ওদের সংসারে অভাব আর নেই।
নিউ সিটির সুপারগেমস কর্পোরেশন এইসব বিপজ্জনক খেলার প্রতিযোগী খুঁজে পায় ওল্ড সিটি থেকেই। ওল্ড সিটির অনেকেই এই খেলায় জিতে ভাগ্য বদল করতে পেরেছে। তখন ওল্ড সিটি ছেড়ে তারা নিউ সিটির পাকাপাকি বাসিন্দা হয়ে গেছে। সেই কারণেই ওল্ড সিটির বহু বেপরোয়া যুবক এইসব হাই-রিসক গেমসে জেতার স্বপ্ন দ্যাখে।
ওল্ড সিটির সব জায়গাতেই টাঙানো রয়েছে ন্যানোটেকনোলজির প্লেট টিভি। চব্বিশ ঘণ্টা ধরে সেই টিভিতে প্রায় একশো চ্যানেল দেখানো হচ্ছে। তার মধ্যে গোটা চল্লিশ চ্যানেলে শুধু নানারকম গেম শো। কখনও লাইভ টেলিকাস্ট, কখনও পুরোনো বাঁধানো ফটোর মতো দেখতে হালকা এবং চ্যাপটা এই টিভিগুলো নিউ সিটির ‘সিন্ডিকেট’ টাঙিয়ে দিয়েছে ওল্ড সিটির কম করেও এক লক্ষ জায়গায়। চারঘণ্টা সূর্যের আলো পেলেই একটা প্লেট টিভি বিনা ব্যাটারিতে চারশো ঘণ্টা চলতে পারে। গরিব এই শহরে বলতে গেলে এটাই সকলের একনম্বর মনোরঞ্জন।
মালিক প্রায়ই জিশানকে এই খেলার ব্যাপারে ওসকায়। বলে, ‘চল, একটা রিসক নিই।’
জিশান অতটা সাহসী হতে পারে না। ও মালিকের মতো ঝাড়া হাত-পা হলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু ওর কিছু হলে তখন মিনি আর শানুর কী হবে? তা ছাড়া মিনি এ ধরনের ফাটকা খেলা পছন্দ করে না।
মালিক বলে, ‘তোর যদি লটঘট কিছু হয়, তা হলে প্রাইজ মানির টুয়েন্টি পার্সেন্ট তোর ফ্যামিলি পাবে। তুই জানিস না, খেলায় নামার আগে ওরা ”নিউলাইফ ইনশিয়োরেন্স” কোম্পানি থেকে স্পেশাল ইনশিয়োরেন্স করিয়ে দেয়!’
হ্যাঁ, জানে জিশান। এবং এও জানে, সেই ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির মালিকও বকলমে সুপারগেমস কর্পোরেশন। কিন্তু তাও…।
‘চল, আমাদের ওল্ড সিটির ফাইট গেম দেখবি চল।’ জিশানের হাত ধরে টান মারল মালিক। নিউ সিটির দেখাদেখি ওল্ড সিটিতেও গেম শো-র হিড়িক পড়ে গেছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, হাতাহাতি লড়াই—’ফাইট গেম’।
মালিক বলল, ‘লাস্ট উইকে আমি আড়াইশো টাকা জিতেছি।’
শুনে হাসি পেয়ে গেল জিশানের। যে লক্ষ-কোটি টাকার স্বপ্ন দেখছে সে মাত্র আড়াইশো টাকা জিতেছে! আড়াইশোকে কত দিয়ে গুণ করলে একশো কোটি হয়? কারণ, একশো কোটি টাকা হল সুপারগেমস কর্পোরেশনের সবচেয়ে বেশি প্রাইজ মানি। ওদের ‘কিল গেম’ খেলায় জিততে পারলে এই মাথা-ঝিমঝিম-করা টাকার অঙ্ক পুরস্কার পাওয়া যায়। জিততে পারলে মানে বাঁচতে পারলে। কারণ, খেলাটা সত্যি-সত্যিই বাঁচা-মরার খেলা। ওল্ড সিটির কত মানুষ যে এই খেলায় নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দ্যাখে! চব্বিশ ঘণ্টার এই খেলায় যে নাম লেখাবে, ওল্ড সিটি আর নিউ সিটির মানুষের কাছে সে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য সুপারহিরো। কারণ, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও একশো কোটি টাকা পুরস্কারের লোভে এই খেলায় নাম লেখানো বড় সহজ কথা নয়! আর খেলাটা চব্বিশ ঘণ্টা ধরে একটানা লাইভ টেলিকাস্ট করা হয় প্লেট টিভিতে। মাঝে-মাঝে থাকে বিজ্ঞাপনের ব্রেক।
জিশানকে হাত ধরে টানতে-টানতে এগোল মালিক। বলল, ‘আজ শনিবার। খেলা ভালো জমবে। চাই কি তুইও দু-একদান লাক ট্রাই করে দেখতে পারিস। কে জানে, ফট করে জিতে গেলে হয়তো বাচ্চার দুধটা কিনে বাড়ি ফিরতে পারবি।’
‘না রে, মিনি এসব জুয়া-ফুয়া পছন্দ করে না। তুই যা, আমি চলি—।’
জিশানের জামা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল মালিক : ‘আরে, একটু তো চল—না হয় একটা ফাইট দেখবি, তারপর কেটে পড়বি। তোর কোনও ভয় নেই—ক্রো-বার্ডও টের পাবে না।’
‘কাকপক্ষী টের না পেলে কী হবে—মিনি ঠিক টের পাবে। ও খারাপ কাজের গন্ধ পায়। তা ছাড়া জুয়ায় জিতে সেই পয়সায় বাচ্চাকে দুধ খাওয়াব! না:, আমায় ছেড়ে দে—আর-একদিন যাব।’
‘আজ আমার কথা শুনতেই হবে তোকে। একটিবার, প্লিজ! তোকে খেলতে হবে না—শুধু আমার খেলা দেখবি। ব্যস, হয়েছে তো!’
সুতরাং নাছোড়বান্দা মালিকের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল জিশান।
মাথার ওপর দিয়ে কয়েকটা ‘শুটার’ উড়ে গেল। নিউ সিটির পুলিশ ফোর্স আকাশে টহল দেওয়ার জন্য এই শুটার হাওয়াযান ব্যবহার করে। যন্ত্রটা নীল আর সাদা রঙের ডোরাকাটা একটা বড়সড় পটল যেন। তার গায়ে পাখনা লাগানো—লেজ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে। রাতের আকাশে সেই আগুন স্পষ্ট চোখে পড়ছে।