লোকগুলো ক্ষুধার্ত দৃষ্টি নিয়ে আগুনের কুণ্ডলী ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারের প্লাস্টিকটা পুড়ে গেলে ভেতরের তামা কিংবা অ্যালুমিনিয়ামটা ওরা ওজনদরে বেচে দেবে।
প্লাস্টিক পোড়া ধোঁয়া পাক খেয়ে-খেয়ে ওপরদিকে উঠছিল। মাথা তুলে ওপরে তাকাল জিশান। ধোঁয়ায়-ধোঁয়ায় রাতের আকাশের সুন্দর কালো রংটাই আর নেই—কেমন যেন লাল আর হলুদের আভা মেশানো ঘোলাটে হয়ে গেছে।
না, শুধু এই তার পোড়ানো ধোঁয়ার জন্য নয়। এই শহরের নানান জায়গায় শুধু কলকারখানা, গাড়ি আর উনুনের ধোঁয়া। প্রায় ষোলো বছর ধরে জিশান এই ব্যাপারটা দেখছে। এ ছাড়া রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরা, যেখানে-সেখানে নোংরার স্তূপ, বাড়িগুলো জীর্ণ মলিন, রাস্তার বেশিরভাগ আলোই খারাপ—সারানোর কেউ নেই, পুলিশ-প্রশাসন বলেও কিছু নেই। সরু ঘিঞ্জি রাস্তায় যে-গাড়িগুলো চলে তাদের মডেল এত পুরোনো যে, ভিনটেজ কার বলা যায় অনায়াসে। আর তাদের যেরকম দোমড়ানো মোচড়ানো চেহারা তাতে সেগুলো যে এখনও চলছে সেটাই বড় কথা।
এককথায় শহরটা আর বেঁচে নেই। আর বেঁচে আছে বলে যদি ধরে নেওয়া যায় তা হলে বলতে হয় শহরটার যক্ষ্মা, পক্ষাঘাত এবং ক্যান্সার হয়েছে। সবাই এটাকে বলে ‘ওল্ড সিটি’, কিন্তু জিশান বলে ‘ডেড সিটি’। এই শহরটা কেউ চালায় না—নিজে থেকে চলছে।
জিশান বাবার কাছে শুনেছে, নব্বই কি একশো বছর আগেও এই শহরের নাম ছিল কলকাতা। তারপর নতুন একটা শহর তৈরি হল তার পাশে। নাম হল ‘নিউ সিটি’। নিউ সিটির গড়ে ওঠার কাজ চলতে লাগল, আর একইসঙ্গে অনাদরে অবহেলায় ভাঙতে লাগল ওল্ড সিটি।
এখন, প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছরের ভাঙা-গড়ার খেলার পরে, ওল্ড সিটি যখন ধুঁকছে, নিউ সিটি তখন টগবগ করছে—সেখানে সবকিছুই নতুন, ঝাঁ-চকচকে, ব্যাপক।
মাথা তুলে আকাশে তাকাল জিশান। ধোঁয়াশা পেরিয়ে অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখতে পেল। গত কুড়ি-বাইশদিন ধরেই দৃশ্যটা সবার চোখে পড়ছে। দুটো প্রকাণ্ড ধূমকেতু পাখনা মেলে ছড়িয়ে রয়েছে আকাশে। একটার রং লালচে, আর অন্যটার আভা নীল। ওদের লেজদুটো ক্রমশ চওড়া হয়ে দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। ওদের পাশে চাঁদের কুমড়োর ফালিটা কেমন ক্ষয়াটে অসুস্থ মনে হচ্ছে।
আনমনাভাবে পথ হাঁটতে শুরু করল জিশান। বাড়িতে ফিরে কী বলবে মিনিকে? এরকম বোকার মতো টাকা হারানোর কোনও মানে হয়! শানুর কথা ভেবে ওর বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল।
আর ঠিক তখনই একটা লোক ছুটে এসে জিশানকে ধাক্কা মারল।
জিশান পড়ে যেতে-যেতে কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিল। তারই মধ্যে টের পেল, লোকটা ধাক্কা মারার সময় ওর পকেটে হাতটা ঢুকিয়েই আবার বের করে নিয়েছে। এবং একইসঙ্গে প্রাণপণ দৌড় লাগিয়ে ঢুকে গেছে একটা অন্ধকার গলিতে।
পকেটে হাত দিয়ে দেখল জিশান। খুচরো পয়সা খানিকটা কমে গেছে। মনে-মনে ভীষণ রাগ হল ওর। পকেটমারি-চুরি-ছিনতাই এ-শহরে রোজকার ঘটনা। জিশান সবসময় সাবধান থাকে বটে, অথচ একটু আগে একশো সত্তর টাকা উধাও হওয়ার ব্যাপারটা ও একেবারেই টের পায়নি।
.
০২.
মুখে একটা তেতো ভাব, মনে একরাশ বিরক্তি—এই অবস্থায় জিশান এলোমেলো দিশেহারাভাবে হাঁটতে শুরু করল। না:, ওল্ড সিটিতে ওর বিরক্তি ধরে গেছে। এখানে শুধু অভাব আর অভাব। দিনের বেলা সূর্য উঠলেও আসলে চব্বিশ ঘণ্টাই অন্ধকার। ষোলো বছর আগে বাবা যদি হঠাৎ করে গরিব হয়ে না যেত তা হলে জিশানকে কোনওদিন ওল্ড সিটিতে আসতে হত না—নিউ সিটিতেই ওরা সুখে থাকতে পারত।
কিন্তু সেটা হয়নি। নিউ সিটিতে সবাই এত বড়লোক যে, সেখানে জীবন চালানোর খরচ অনেক বেশি। সবকিছুর দাম প্রায় আকাশছোঁয়া। চারিদিকে অঢেল সুখ আর আহ্লাদ। বাবার মুখেই এসব কথা শুনেছে জিশান। তখন ও খুব ছোট।
বাবা আর নেই। চোদ্দো বছর আগে বাবা চলে গেছে।
‘অ্যাই, জিশু!’
কে যেন আচমকা ডাকল জিশানকে।
ফিরে তাকাল জিশান। দেখল, হনহন করে হেঁটে আসছে মালিক।
ওর ছোটবেলার বন্ধু জিশান। একসময় একসঙ্গে খেলাধুলো করেছে। দুটো পয়সা উপায় করার জন্য বাগজোলা খালে মাটিও কেটেছে দুজনে।
মালিকের লম্বা শক্তপোক্ত চেহারা—অনেকটা জিশানের মতোই। তবে জিশানের মতো ফরসা নয়—ঠিক উলটো—কুচকুচে কালো। হাসলে পর অন্ধকার রাতের তারার ঝিকিমিকির মতো দাঁতের সারি ঝলসে ওঠে। এখনও তাই হল।
একটু পা টেনে-টেনে চলে মালিক। কাছে এসে ও জিশানের কাঁধ চাপড়ে দিল : ‘কী রে, মুখখানা এরকম আউল-আউল কেন?’
মালিক সবসময় পাখির নামগুলো ইংরেজিতে বলে। এককালে যে ওয়ার্ডবুক মুখস্থ করেছে সেটা কিছুতেই ভুলতে চায় না।
জিশান ওকে টাকা হারানোর গল্পটা বলল।
মালিক শব্দ করে থুতু ফেলল ঘেন্নায়, বলল, ‘এই নোংরা শহরটায় সালা আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু নিউ সিটিতে যে যাব সে-ক্ষমতাও নেই। এমনই পোড়া কপাল!’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মালিক বলল, ‘তবে আমি হার্ট অ্যান্ড সোল চেষ্টা করছি—দেখি কিছু করতে পারি কি না।’
জিশান জানে, মালিক কী চেষ্টা করছে। নিউ সিটিতে অনেক গেম শো হয়। তাতে প্রচুর টাকার প্রাইজ মানি থাকে। আর প্রতিটি খেলা লাইভ টেলিকাস্ট করা হয়। এই খেলায় একবার দাঁও মারতে পারলেই নবাব। দুনিয়া মুঠঠি মে। কিন্তু খেলাগুলোয় দারুণ ঝুঁকি রয়েছে। এক-একটা খেলা তো একেবারে দম বন্ধ করা ব্যাপার। খেলাগুলোর বেশিরভাগই চালায় ‘সুপারগেমস কর্পোরেশন’।