অপটিক্যাল ট্যাবলেট দেখে নিজের অবস্থানটা বুঝতে চাইল জিশান। তারপর পুবদিক লক্ষ্য করে হাঁটা দিল। ও জানে, কিছুটা পথ গেলেই মেটাল রোড পাওয়া যাবে। সেখান থেকে একটা গাড়ি কিংবা মোটরবাইক নিয়ে নেবে। তারপর আবার দৌড়…দৌড়…দৌড়…।
মেটাল রোডের কাছাকাছি আসতেই অনেক আলো দেখতে পেল। সেইসঙ্গে চপারের ইঞ্জিনের শব্দ, শুটারের শিস, আর মানুষজনের হইচই।
হঠাৎই পিছন থেকে ফিসফিস করে কে যেন ডেকে উঠল : ‘জিশানদা!’
জিশান চমকে উঠল। এক ঝটকায় পিছন দিকে ঘুরে গেল। লেজার ব্লাস্টার তাক করল অন্ধকারের দিকে। দেখল, সেই অন্ধকারের গায়ে সার্চলাইটের টুকরো-টুকরো আলো জোনাকির মতো বিচিত্র নকশা কেটে দিয়েছে।
সেই নকশা গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে আছে একজন ছ’ফুটের বেশি লম্বা মানুষ—যে দৌড়ে হরিণকে হার মানাতে পারে। যে অনায়াসে পাঁচ-পাঁচটা খারাপ মানুষকে খতম করতে পারে।
‘সুখারাম নস্কর….।’ প্রায় ফিসফিস করে উচ্চারণ করল জিশান।
‘হ্যাঁ—সুখারাম, জিশানদা।’ জিশানের আরও কাছে এগিয়ে এল ও : ‘আমি তোমাকে কিছুতেই মারতে পারব না। কেন না ভালো মানুষদের আমি মারতে পারি না। তাতে মার্শালের হাতে আমাকে মরতে হয় মরব—।’
জিশান কী বলবে, কী করবে, বুঝে উঠতে পারছিল না। তবে এটুকু বুঝতে পারছিল, সুখারাম নস্কর কেন এতক্ষণ ধরে ওকে ‘খুঁজে’ পায়নি।
সুখারাম জিশানের হাত চেপে ধরল : ‘এসো, জিশানদা। জলদি। আর সময় নেই।’
ওরা ঘুরপথে মেটাল রোডের দিকে এগোল। সুখারাম খুব নীচু গলায় কথা বলছিল। ও জিশানের ওপরে অনেকক্ষণ ধরেই নজর রাখছে, যাতে জিশানের কোনও বিপদ না হয়। জিশানকে বাঁচানোর জন্য খেলার সব নিয়মকানুন ভেঙে প্রাোটনকেও ও শেষ করে দিত। কিন্তু তার আগেই কালো বাঘ সেজে নিয়তি হাতে লাগাম তুলে নিয়েছে।
দুটো আগুনের তির কোথা থেকে যেন ছুটে এল। ওদের কাছাকাছি গাছপালার ওপরে ঠিকরে পড়ে কানফাটানো বিস্ফোরণ ঘটাল। কালো ধোঁয়া, পোড়া গন্ধ।
শ্রীধর পাট্টা নিশ্চয়ই এয়ার অ্যাটাকের নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু হঠাৎ এ-নির্দেশ কেন?
জিশান আর সুখারাম দৌড়তে শুরু করল।
একটু পরেই ওরা গাছপালা পেরিয়ে মেটাল রোডে পৌঁছে গেল। রাস্তার পাশে দাঁড় করানো একটা গাড়িতে উঠে বসল। তারপর সুখারামের হাতে গাড়ি চলতে শুরু করল।
ওদের ছুটন্ত গাড়ি লক্ষ্য করে মিসাইল ছুটে আসছিল বারবার। চোখে পড়ছিল আগুনের রেখা আর শব্দ। কিন্তু সুখারাম কুশলী হাতে স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছিল, অ্যাক্সিলারেটরের কন্ট্রোল সুইচ অপারেট করছিল।
কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই ওদের থামতে হল।
কারণ, সামনের রাস্তা জুড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য!
জায়গাটা আলোয় আলো। চওড়া রাস্তার মাঝে চারটে শুটার দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর তার ঠিক মাঝখানে একটা চপার—তার ইঞ্জিন চলছে। চপারটার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীধর পাট্টা। আর কোনও উপায় না দেখে নিজেই গেম সিটিতে চলে এসেছেন।
কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, রাস্তার দুপাশে বহু মানুষের ভিড়। মনে হচ্ছিল যেন গেম সিটির সব মক সিটিজেন শ্রীধর পাট্টাকে ঘিরে জড়ো হয়ে গেছে। ওরা হইচই করছে, জিশানের নাম ধরে চিৎকার করছে।
সব চিৎকার হইচই ছাপিয়ে হঠাৎই শ্রীধরের গলা শোনা গেল। একটা মেগাফোন ব্যবহার করে তিনি কথা বলছেন।
‘সব খেলা শেষ, জিশান! আর পালানোর পথ নেই। তুমি কিল গেমের নিয়ম ভেঙেছ—তাই সব খতম। এক্ষুনি নেমে পড়ো গাড়ি থেকে। নইলে আমি শুট করার অর্ডার দেব…।’
ভিড় করে থাকা জনতা প্রতিবাদের চিৎকার করে উঠল।
জিশান গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। একটা হাত ওপরে তুলে বলল, ‘এটা অন্যায়। এ-অন্যায় আপনি করতে পারেন না, মার্শাল—।’
নিজস্ব ঢঙে ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন শ্রীধর : ‘জিশান, তুমি বোধহয় ভুলে গেছ, নিউ সিটিতে আমিই শেষ কথা।’
‘মোটেই না!’ চিৎকার করে বলল জিশান, ‘সবসময় জনগণই শেষ কথা বলবে। সবাই জানে, আমি কোনও দোষ করিনি…।’
জনতা আবার চেঁচিয়ে উঠল। ভিড়ের মধ্যে থেকে কয়েকটা বাক্স, কৌটো আর ইট-পাটকেল ছিটকে গেল শ্রীধরের শুটার-বাহিনীর দিকে।
দুজন গার্ড শূন্যে ফায়ার করে জনতাকে ‘ধমক’ দিল।
জিশান বলল, ‘মার্শাল, ভুলে যাবেন না, লাইভ টেলিকাস্ট এখনও চলছে। সবাই আপনার এই অন্যায় দেখছে…।’
হাসলেন শ্রীধর। মাটির দিকে থুতু ছেটালেন। তারপর মুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘…ইয়োর লাইভ টেলিকাস্ট! সবাই এবার ডেড টেলিকাস্ট দেখবে।’ ডাইনে-বাঁয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন মার্শাল। তারপর : ‘নাউ, কাম অন। হাত মাথার ওপরে রেখে ধীরে-ধীরে এগিয়ে এসো আমাদের কাছে। আমি দশ পর্যন্ত গুনব। ওয়ান…টু…থ্রি…।’
হঠাৎই জিশানকে অবাক করে দিয়ে সুখারাম এক হ্যাঁচকায় গাড়ি ছুটিয়ে দিল। এবং জিশান বা অন্যান্য কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর গাড়ি মিসাইলের মতো ধেয়ে গেল শ্রীধর পাট্টার দিকে।
জনতা চিৎকার করে উঠল। গার্ডরা সুখারামকে লক্ষ্য করে বেশ কয়েকবার ফায়ার করল বটে, কিন্তু তাতে কাজ হল না।
সুখারামের গাড়ি বিদ্যুৎবেগে ছুটে গিয়ে শ্রীধরের চপারে সরাসরি ধাক্কা মারল।
সংঘর্ষ, বিস্ফোরণ, আগুন, ধোঁয়া।
শ্রীধর পাশের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। আর একইসঙ্গে জনগণ গার্ডদের ওপরে জলপ্রপাতের মতো লাফিয়ে পড়ল। শুরু হয়ে গেল দক্ষযজ্ঞ। প্রবল চিৎকার-চেঁচামেচির মধ্যে ফায়ারিং-এর শব্দও শোনা গেল।