যন্ত্রণায় মুচড়ে ওঠা গলায় প্রাোটন প্রায় ফিসফিস করে বলল,’ জিশান… তুমি জিতে গেলে। আমি…আমি…।’
প্রাোটনের কথা ভালো করে শোনার জন্য জিশান ওর মাথার কাছে উবু হয়ে বসে পড়ল। ব্লাস্টারটা শক্ত মুঠোয় ধরা রইল।
‘আমি…আমি…শেষ। বোনাস লাইফ নিয়ে অনেকদিন টিকে ছিলাম। আর…আর এটাই স্যাটিসফ্যাকশন যে…যে মানুষের হাতে আমাকে মরতে হল না…।’
সব জ্বালা-যন্ত্রণা ভুলে জিশান প্রাোটনের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
প্রাোটনের গলা একেবারে মেয়েদের মতো। চোখ-মুখের আদলটাও সেরকমটাই লাগছে না কি?
এই মেয়েটাই একজন সুপারকিলার! যার আসল পরিচয় মিডিয়া শেষ দিন পর্যন্ত গোপন রেখেছে!
‘তুমি…তুমি…মেয়ে?’ জিশান জিগ্যেস করল। বাঁ-হাতের গড়িয়ে পড়া রক্ত মুছে নিল।
‘হ্যাঁ, শুরুতে তো তাই ছিলাম। খেলাধুলো ভীষণ ভালোবাসতাম…।’
প্রাোটনের স্যাটেলাইট ফোন বাজতে শুরু করল। বাজতেই থাকল। প্রাোটন ফোন ধরার মতো অবস্থায় নেই। ও মলিন চোখে জিশানের দিকে তাকিয়ে ছিল, আর আস্তে-আস্তে কথা বলছিল।
জিশান শুনতে লাগল প্রাোটনের কথা।
ছোটবেলা থেকেই অ্যাথলেটিকসে টান ছিল। প্রাইজও পেয়েছে অনেক। খানিকটা ডানপিটে গোছের হওয়ায় বেশিরভাগ সময় ছেলেদের দঙ্গলে ভিড়ে থাকত। তা ছাড়া, ছিপছিপে চেহারা, বয়কাট চুল এসব দেখে অনেকে ওকে ছেলে বলেও ভুল করত।
বয়েস বাড়তে লাগল, আর তার সঙ্গে-সঙ্গে প্রাোটন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগল। ধীরে-ধীরে ছোটখাটো ক্রাইমে জড়িয়ে পড়তে লাগল। আঠেরো বছর পেরোতে না পেরোতেই ও প্রথম খুন করে বসল। কিন্তু পুলিশ ঠিকমতো কেস সাজাতে পারেনি বলে ও তিন বছর জেল খেটে রেহাই পায়।
এরপর ও একটা মারাত্মক গ্যাং ওয়ারে জড়িয়ে পড়ে। পাহাড়ি এলাকার সেই গ্যাং ওয়ারে প্রচুর গোলাগুলি চলে। সেখান থেকে পালানোর সময় প্রাোটনদের জিপ একটা বাঁকের মুখে রাস্তা ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে যায় শূন্যে।
জিপের সবাই মারা গিয়েছিল—একমাত্র প্রাোটন ছাড়া।
তবে ওর অবস্থা যা হয়েছিল তাতে ওকে বাঁচানো যাবে বলে কেউ ভাবেনি। ওর গোটা শরীরটা দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিল। চোখ ঢুকে গিয়েছিল গর্তে, মাথার খুলির খানিকটা অংশ কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল।
সেই সময় নিউ সিটির বারোজন বিজ্ঞানী একটা কোর রিসার্চ গ্রুপ তৈরি করে রোবোটিক্স আর অ্যানড্রয়েড টেকনোলজি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাঁদের নানান পরীক্ষার জন্য ‘সাবজেক্ট’ দরকার হয়ে পড়েছিল। তাই প্রাোটনকে তাঁরা ‘সাবজেক্ট’ হিসেবে চেয়ে বসেন। নিউ সিটির সিন্ডিকেট সেই অনুরোধে সায় দেয়।
তারপর বছরের পর বছর চিকিৎসা আর গবেষণা চলতে থাকে। রোবোটিক্স, আরটিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স আর বায়োটেকনোলজি হাত ধরাধরি করে প্রাোটনের ওপরে কাজ করতে থাকে। রক্ত, মাংস, হাড়ের সঙ্গে মিশে যায় স্টিলের প্লেট, ব্যাটারি, তার, সুইচ, অপটিক্যাল সেন্সর, এল. ই. ডি. বাতি আর অসংখ্য মাইক্রোচিপ।
শেষ পর্যন্ত তিন বছরের চেষ্টায় তৈরি হয় সুপারকিলার প্রাোটন। শ্রীধর পাট্টা ওকে ‘সুপারহিউম্যান কিলিং মেশিন’ নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু…।
প্রাোটনের কথা শুনতে-শুনতে খানিকটা আনমনা হয়ে পড়েছিল জিশান। তবে ওর চোখ আর কান সাজাগ ছিল। ও শুনতে পেল বেশ কয়েকটা চপারের শব্দ। তার সঙ্গে শুটারের শিস।
কাউন্টডাউন রিস্টওয়াচের দিকে তাকাল জিশান। আর মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট! গত কয়েকটা ঘণ্টা কী করে এত তাড়াতাড়ি পেরিয়ে গেল কে জানে! জিশান অবাক হয়ে ভাবল, সত্যি-সত্যি কি কিল গেমের চব্বিশ ঘণ্টা শেষ হতে চলেছে? না কি ও স্বপ্ন দেখছে?
একবার প্রাোটনের দিকে তাকাল। এখন ওর বুকের কোনও ওঠা-নামা নেই—কালো বাঘটার মতোই স্থির।
কিন্তু জিশান এখন কী করবে? জঙ্গলের মধ্যেই এলোমেলো ছুটে বেড়াবে? না কি খোলা রাস্তায় বেরিয়ে মক সিটিজেনদের আস্তানায় গা-ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করবে? ওদের কাছে আশ্রয় চাইবে?
জিশানের মাথা ঠিকমতো কাজ করছিল না। কিলার সুখারাম এখন কোথায় আছে? কতদূরে?
আন্দাজে জিশানের মনে হল, বেশি দূরে নয়। সুখারামের ট্র্যাকারে জিশানের সবুজ ডট দেখা যাচ্ছে না বটে তবে প্রাোটনের লাল ডটটা নিশ্চয়ই দেখা যাচ্ছে। সুতরাং, এই অবস্থায় সেরা স্ট্র্যাটেজি হল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুজন কিলারের একজোট হয়ে যাওয়া। তার মানে, সুখারাম নিশ্চয়ই প্রাোটনের লাল ডট লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে।
প্রাোটনের ফোন আবার বেজে উঠল। বাজতেই থাকল।
জিশানের মনে হল, সুখারাম ফোন করে প্রাোটনের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে, আর কথা বলতে না পেরে মরিয়া হয়ে ধেয়ে আসছে প্রাোটনের খোঁজে—জিশানের খোঁজে।
রুকস্যাকে সব গুছিয়ে নিয়ে টলতে-টলতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। শুধু ডানহাতের মুঠোয় ধরা রইল ব্লাস্টার গান। ওর শরীরের যা অবস্থা তাতে সুখারামের মুখোমুখি হলে কতটা মোকাবিলা করতে পারবে সেটাই প্রশ্ন।
পথ চলতে শুরু করল জিশান। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে খিদে আর ঘুম। কিন্তু তা সত্বেও আরও কিছুক্ষণ অন্তত ওকে শরীরটাকে সচল রাখতে হবে।
রুকস্যাক থেকে অপটিক্যাল ট্যাবলেট বের করে ফুড ম্যাপ দেখল। তারপর সবচেয়ে কাছের ফুড পয়েন্টে গিয়ে চটপট কিছুটা খিদে-তেষ্টা মিটিয়ে নিল। মুখে-চোখে জলের ঝাপটা দিল।