রউফ লালার কথা মনে পড়ে গেল জিশানের। কিন্তু ওর বেলায় তবু একটা প্রাইজ-টাইজের ব্যাপার জড়িয়ে ছিল! এখানে তো তা নেই—বরং কুটিল শাস্তিই হয়তো ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু তা হলে এই মানুষগুলো এরকম পাগলামো করছে কেন? ওদের ভয়ডর নেই!
জঙ্গলের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছিল জিশান। কখনও গাছের আড়ালে, বা কখনও গাছের ওপরে বেয়ে উঠে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করছিল। কিন্তু শরীরের যা অবস্থা তাতে গাছ বেয়ে ওঠার কাজটা মারাত্মকরকম কঠিন হয়ে পড়ছে।
ঘাম আর রক্ত মিশে গিয়ে জিশানের কাটা জায়গাগুলো জ্বলছিল। ও বারবার সেগুলোর ওপরে হাত বোলাচ্ছিল। আলো আর অন্ধকারের জাফরির মধ্যে দিয়ে এদিক-ওদিক নজর চালাচ্ছিল।
হঠাৎই ও দেখতে পেল দুটো হলদেটে সবুজ চোখ। তাদের ঘিরে গাঢ় কালো ছায়া।
জিশান একটুও দেরি না করে হাঁটুর কাছে লাগানো হোলস্টার থেকে লেজার ব্লাস্টার বের করে নিল। এবং ফায়ার করল।
কালো ছায়াটা শূন্যে লাফ দিয়েছিল। একইসঙ্গে চাপা গর্জন করে উঠেছিল। সেটা এখন ‘উড়ে’ এসে জিশানের কাছাকাছি আছড়ে পড়ল। ওটার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে হিংস্র গজরানি।
প্রকাণ্ড একটা কালো বাঘ। আক্রোশে লেজ আছড়াচ্ছে। পাগলের মতো থাবা ছুড়ছে শূন্যে। ফুঁসছে।
কালো বাঘ যে এত বড় মাপের হয় জিশান জানত না। আর ও এও জানত না, এরা এত জানদার।
তবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাঘটা বেশ নিস্তেজ হয়ে পড়ল।
জিশান বাঘটাকে লক্ষ্য করে আবার ফায়ার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখনই একটা গরম কিছু ওর বাঁ-কাঁধ ছুয়ে বেরিয়ে গেল। আর সেই ‘ছোঁয়ার’ অভিঘাতটা এতই মারাত্মক হল যে, জিশানের দেহটা পলকে দুটো পাক খেয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে। ওর বাঁ-কাঁধটা আগুনের আঁচে জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছিল।
তখনই প্রাোটনকে জিশান দেখতে পেল। ওর কাছ থেকে প্রায় সাত-আট হাত দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সরু ছিপছিপে একটা ইস্পাতের চাবুক। চোখের ওপরে ঢাকা কালো কাচ থেকে জঙ্গলের আলোর ঢেউ ঠিকরে পড়ছে। ওর দু-হাতে দু-দুটো অস্ত্র।
জিশানের মনে হল, এইমাত্র প্রাোটন দুটো অস্ত্রই ব্যবহার করেছে : একটা জিশানের ওপরে, আর-একটা কালো পশুটার ওপরে।
এবার তা হলে সব শেষ। এত চেষ্টা, এত পরিশ্রম, এত লড়াই—সব শেষ! জিশানের শরীরের এখন যা অবস্থা তাতে ও কী পালটা কিছু করে প্রাোটনকে ঘায়েল করতে পারবে? ওর হাত আর কাঁধের যন্ত্রণাটা এখন এত বেড়ে গেছে যে মনে হচ্ছে, কেউ যেন মাংসের ভেতরে তুরপুন গেঁথে নিষ্ঠুরভাবে মোচর দিচ্ছে।
কিন্তু প্রাোটন কী করে ওকে খুঁজে পেল? ট্র্যাকারে তো ওর পজিশন প্রাোটন দেখতে পায়নি!
সেটা দেখতে না পেলেও প্রাোটন হাল ছাড়েনি। বুদ্ধি খাটিয়েছে, পরিশ্রম করেছে, আর ওর আই গিয়ারে লাগানো নাইটভিশান ইন্সট্রুমেন্টের সাপোর্ট নিয়েছে। তার ওপরে ভাগ্যও ওকে সাহায্য করেছে।
প্রাোটনের জায়গায় জিশান থাকলেও ঠিক একইরকম মরিয়া চেষ্টা করত।
আর সুখারাম? ও-ও কি জিশানকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে না? ও কি জিশানদের ফায়ারিং-এর শব্দ শুনতে পায়নি?
জিশানের নজর মাঝে-মাঝেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ও জোর করে নিজেকে আবার সজাগ করে তুলেছিল। মিনি, শানু…আর সবার জন্য ওকে যে লড়তে হবে! যে করে হোক, লড়তে হবে।
মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় শরীরটাকে কয়েক ডিগ্রি ঘোরাল জিশান। ডানহাতের আঙুলগুলো গুটিগুটি ব্লাস্টারের হাতলের দিকে এগোতে লাগল।
প্রাোটন চুপচাপ দাঁড়িয়ে জিশানকে দেখছিল। ওর ঠোঁটের রেখাটা সামান্য চওড়া হল। তারপর ডানহাতে ধরা লং রেঞ্জ মালটিশুটার পিস্তলটা জিশানের মাথা লক্ষ্য করে তাক করল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আহত কালো বাঘটা সবাইকে চমকে দিয়ে বিদ্যুতের মতো প্রাোটনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
প্রাোটন ফায়ার করল বটে, কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হল না। কারণ, বাঘটা মারা যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে প্রাোটনকেও ছিঁড়ে-খুঁড়ে রেখে দিয়ে গেল।
গাছপালার গন্ধের সঙ্গে বারুদের গন্ধ মিশে গেল। ফায়ারিং-এর শব্দে অন্ধকারের পশুপাখিরা চঞ্চল হয়ে ডাকাডাকি শুরু করল। কয়েকটা জন্তুজানোয়ারের ছুটোছুটির শব্দও পাওয়া গেল যেন।
জিশান অতি কষ্টে উঠে বসল। তারপর একটা গাছের গুঁড়িতে কোনওরকমে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
বাঘটার দিকে একবার তাকাল। একেবারে নিথর, স্পন্দনহীন।
তারপর জিশান তাকাল প্রাোটনের দিকে। পায়ে-পায়ে সেদিকে এগোল।
প্রাোটন চিত হয়ে পড়ে আছে। তবে ওর মাথাটা একপাশে ঘুরে গেছে। দু-হাত থেকে অস্ত্র খসে পড়েছে। পোশাক ছিঁড়ে গেছে বেশ কয়েক জায়গায়। কোমরের কাছ থেকে বাঁ-পাটা খানিকটা যেন খুলে বেরিয়ে এসেছে। মুখটা অল্প খোলা—বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছে। গায়ে নানা জায়গায় রক্ত লেগে রয়েছে। চোখে শূন্য দৃষ্টি। যেন রাতের জঙ্গলের রূপ দেখে হতবাক হয়ে গেছে।
হঠাৎই জিশান খেয়াল করল, প্রাোটনের বাঁ-পায়ের একটা জায়গায় চামড়া উঠে গেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে চকচকে ধাতু—হয়তো স্টেইনলেস স্টিল কিংবা অন্য কিছু।
ঠিক একইরকম ব্যাপার দেখা গেল ডান কাঁধে আর গালে। তা ছাড়া জিশান লক্ষ করল, প্রাোটনের ঘাড়ের পাশে দুটো ছোট লাল বাতি দপদপ করছে।
জিশানের সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল। চামড়া, রক্ত, মাংস, মেটাল, লালবাতি…এসবের মানে কী?