শিস দিয়ে কিছুক্ষণ ওড়াউড়ি করল ওরা। স্যাটেলাইট ফোনে ঘন-ঘন খবর পাঠাতে লাগল ওপরওয়ালাকে।
‘এখন কী করব, স্যার?’
‘শুট ডাউন দ্য ব্লাডি ক্রাউড, য়ু মোরন! শুট রাইট নাও! ওদের ছড়িয়ে ছিটকে ছত্রখান করে দাও! চুরচুর করে দাও! যেভাবে হোক জিশানের ওয়াইফ আর সানকে আমাদের চাই-ই চাই! আমাদের মার্শালের স্পেশাল অর্ডার। গো অ্যাহেড…রাইট নাও!’
একটা শুটারের একজন গার্ড জনতার দম আটকানো ভিড় লক্ষ্য করে ওর অটো-পিস্তল ফায়ার করল।
কয়েক ঝলক আলো। কয়েকটা ‘ফট-ফট’ শব্দ।
জনতার ভিড়ে কারও গায়ে গুলি লাগল কিনা না বোঝা গেল না। তবে দশ-বিশজন মানুষ চিৎকার করে ভয়ে ছুটে পালাল। বাকি কয়েক হাজার মানুষ কিন্তু নড়ল না। দু-চারজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘শুয়োরের বাচ্চাদের কাছে কত গুলি আছে? একশো? দু-শো? আর আমরা হাজার-হাজার। মিনি আর শানুকে আমরা কিছুতেই ছাড়ব না!’
‘ছাড়ব না, ছাড়ব না!’ জনসমুদ্রগর্জনে সেই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল।
আর একইসঙ্গে জনতার ঝাঁক থেকে বেশ কয়েক ডজন গুলি ছুটে গেল শুটারবাহিনী তাক করে। দুজন গার্ডের হাতে আর কোমরে গুলি লাগল। বাকি গুলিগুলো ছিটকে গেল আকাশে। আর কয়েকটা শুটারের মেটাল বডিতে ধাক্কা খেয়ে ‘ঠং’ শব্দ তুলে দিগভ্রান্তের মতো ঠিকরে গেল।
বেশ বোঝা গেল, ওল্ড সিটির জনগণ মোটেই নিরস্ত্র নয়।
এটা ঠিকই যে, ওল্ড সিটির রিভলভারের মডেলগুলো বেশ পুরোনো, কিন্তু তা থেকে এখনও ঠিকঠাক গুলি বেরোয়, আর সে-গুলি কারও গায়ে লাগলে সে আহত কিংবা নিহত হতে পারে।
সুতরাং, আটটা শুটার মুখ ঘোরাল। উড়ে গেল জিশানের বস্তি থেকে অনেকটা দূরে। ওরা হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে উত্তেজিতভাবে ফোনে কথা বলেই যাচ্ছিল।
মিনি বাড়ির কাছেই একটা সরু গলিতে দাঁড়িয়ে প্লেট টিভিতে জিশানের কিল গেম দেখছিল। মরণ খেলাটা শেষ হতে আর দু-ঘণ্টা মতন বাকি। একটু পরেই হয়তো ভোরের আলোর আভা ফুটে উঠবে। তাই বারবার মুখ তুলে আকাশের দিকে দেখছিল ও।
ও: ভগবান! আর একটু! আর একটু!
অর্কনিশান বাড়িতে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বস্তিরই একটি কিশোরী মেয়ে ওকে পাহারা দিচ্ছে। মেয়েটি জানে যে, মিনিবউদির আজ সারারাত টিভি দেখা দরকার। তাই ও মিনির হয়ে প্রক্সি দিচ্ছে।
হঠাৎই জনতার গর্জনের বিস্ফোরণে বস্তির সবাই চমকে উঠল। মিনিও।
ও এতক্ষণ ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল, কাঁপছিল। শুটারের শিসের শব্দ শোনার জন্য কান পেতে ছিল। কিন্তু সেই শব্দটা শুনতে-না-শুনতেই ভেসে এল ক্ষিপ্ত জনতার ভয়ংকর গর্জন।
তারপর খুব দ্রুত কীসব যে ঘটে গেল!
ফিসফাস। কানাকানি। কথা চালাচালি।
তারপরই মিনিকে আর শানুকে পিস ফোর্সের হাত থেকে বাঁচাতে অসংখ্য জেহাদি নারী-পুরুষ মিনির ঘর আর মিনিকে ঘিরে বস্তির সব অলিগলিতে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওরা যে যেমন পেরেছে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। ওদের ঠোঁটে উত্তেজনা আর প্রতিরোধের জিগির। দূর থেকে কানে আসা জনতার গর্জনের সঙ্গে ওদের গর্জন মিলে গেল। যেন দু-দুটো সমুদ্রের দুরন্ত ঢেউ হাতে হাত মিলিয়ে কোলাকুলি করল। ওদের স্লোগান শুনতে-শুনতে মিনির চোখে জল এসে গেল।
জিশানকে এত মানুষ ভালোবাসে!
ওরা বলছে, ‘জান দেব, তবু জিশানকে দেব না! জিশান জিন্দাবাদ! জিশান আমাদের ছিল, আমাদের থাকবে!…।’
ওল্ড সিটির বড়-বড় রাস্তাগুলোয় তখন এক অভাবনীয় দৃশ্য : কাতারে-কাতারে মানুষ ছুটে চলেছে মাস্টার ব্রিজের দিকে—যে-ব্রিজ নিউ সিটি আর ওল্ড সিটিকে আলাদা করে রেখেছে। জিশান-পাগল মানুষের দল এখন আর পিস ফোর্সের গার্ডদের গুলির পরোয়া করে না। ওরা পরিখার পরোয়া করে না। পরোয়া করে না পিরানহা মাছ কিংবা বিষধর সাপের। ওরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলছে যে, আজ ওরা মাস্টার ব্রিজের প্রতিরোধ ভাঙবেই।
আজ ওরা জনসমুদ্রের জোয়ারে রাতের নিউ সিটি ভাসিয়ে দেবে। দেবেই।
নিউ সিটি আর ওল্ড সিটিতে দু-রকমের দুটো আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটে গেল। বেরিয়ে এল দু-রকমের দুটো লাভাস্রোত।
কিন্তু সেই লাভাস্রোত দুটো ধীরে-ধীরে মিশে যাচ্ছিল পরস্পরের সঙ্গে।
একটু পরেই দুটো স্রোতকে আর আলাদা করে চেনা গেল না।
•
জিশানের পাগল-পাগল লাগছিল।
এরপর কী? এরপর কী?
বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল ও। কালো আকাশটাতে খুব সামান্য হলেও ধূসরের ছোঁয়া লেগেছে না? হে ভগবান! আর কিছুটা সময় আমাকে বাঁচিয়ে রাখো। মিনি আর শানুকে আমি একবার দেখতে চাই। একবার—মাত্র একবার…।
যন্ত্রণা আর ক্লান্তির সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করছিল আর এলোমেলোভাবে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছিল। তখনই জিশান দেখতে পেল, গেম সিটির ভেতরে একটা ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। অনেক মোটরবাইক আর গাড়ি নানান দিকে ছুটে যাচ্ছে। তার সঙ্গে কিছু চিৎকার চেঁচামেচি।
বাইকের কয়েকজন মানুষকে লক্ষ করল জিশান। ওদের গায়ে কোনও স্পেশাল ইউনিফর্ম নেই। ওরা বোধহয় সিভিলিয়ান—গেম সিটির মক সিটিজেন।
কিন্তু ওরা এভাবে গেম সিটির রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে কেন?
একটু পরেই প্লেট টিভির পরদায় এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল। গেম সিটির সিটিজেনরা জিশানকে খুঁজে বের করে আগলে রাখতে চাইছে। ওরা চাইছে জিশানের গায়ে আর যেন আঁচড়টিও না লাগে। তাই ওরা নিয়ম ভেঙে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পথে নেমে পড়েছে।