কথা বলতে-বলতে জিশান প্যান্টের কোমরের আড়াল থেকে মিনি আর শানুর ফটোটা শূন্যে তুলে ধরল। কান্না ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলল, ‘ওদের আপনারা বাঁচতে দিন! সৎ আর সুন্দরভাবে বাঁচতে দিন! পৃথিবী এখনও আমাদের সবার কাছে সুন্দর। প্লিজ, ওদের…ওদের বাঁচতে দিন…!
জিশান কান্না চাপতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারছিল না। মিনি আর শানু যে ওর সবচেয়ে বড় দুর্বল জায়গা!
কিন্তু একইসঙ্গে ও চোয়াল শক্ত করে রেখেছিল। চোয়ালের রেখা দেখে বোঝা যাচ্ছিল, কিল গেমে ও মোটেই হারতে চায় না।
•
জিশানের মরিয়া আবেদন লক্ষ-লক্ষ টিভি দর্শকের কাছে পৌঁছে গেল। গেল শুধু নয়, তাদের অনেকেরই বুকে গিয়ে বিঁধল। তারা ওল্ড সিটির মানুষ। তারা নিউ সিটির মানুষ।
নিউ সিটিতে যে-ঘটনা ঘটল সেটা এককথায় অভিনব। যেসব মানুষ ভাবত তাদের মধ্যে আবেগ ব্যাপারটা দিব্যি বেঁচেবর্তে রয়েছে, হঠাৎই তারা আবেগের একটা ঢেউ টের পেল। সেই ঢেউটা যেমন বিশাল, তেমনই শক্তিশালী।
আর যেসব মানুষ ভাবত তাদের মধ্যে আবেগ-টাবেগ খুব একটা বেশি-টেশি নেই-টেই…নিউ সিটিতে থাকতে-থাকতে সেই ব্যাপারটা বলতে গেলে শুকিয়ে-টুকিয়ে গেছে, তারাও হঠাৎ টের পেল তাদের শরীরে, মনে কিংবা মাথায় একটা হিমশীতল পোকা কী এক অলৌকিক ম্যাজিকে আচমকা যেন নড়ে উঠল।
নিউ সিটির মানুষদের অনেকেই ফোন তুলে নিয়ে তাদের চেনা বৃত্তের মানুষজনকে ফোন করতে শুরু করল। কিল গেম খেলায় এই অবিচার কিংবা ব্যভিচার তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। শ্রীধর পাট্টা যতই ক্রিমিনাল রিফর্ম ডিপার্টমেন্ট আর পিস ফোর্সের মার্শাল হোন না কেন এই অন্যায় তিনি করতে পারেন না।
নিউ সিটির মানুষদের মধ্যে শুধু কথার দেওয়া-নেওয়া চলতে লাগল। অন্ধকার রাতের সাইবারস্পেসে মানুষের ক্ষোভ আর অসন্তোষের ঝাঁজ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুপারগেমস কর্পোরেশনের কন্ট্রোল রুমের হেলপলাইনে ফোনের সুনামি ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার পাশাপাশি ই-মেল আর ভিডিয়ো কলের বন্যা। আগের বারের তুলনায় এবারের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বোধহয় কম করেও একশো গুণ বেশি।
সিন্ডিকেট বিল্ডিং-এ শ্রীধর পাট্টা রাগে দাউদাউ করে জ্বলছিলেন। দুটো আর্ক কম্পিউটার মাথায় ওপরে তুলে সপাটে আছড়ে মারলেন মার্বেল মোড়া মেঝেতে। ওঁর শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছিল।
নিউ সিটির সব হতচ্ছাড়া মানুষগুলো হঠাৎই যেন যক্ষ্মা-পাগল হয়ে গেছে। ওদের টেলিফোন, ই-মেল আর ভিডিয়ো কলের ভাষা এতটাই নোংরা হয়ে গেছে যে, শ্রীধরের মাথার শিরা দপদপ করছিল—সেইসঙ্গে বুকে আর মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। এই বুঝি হার্টফেল হয়ে যাবে!
আকাশ থেকে নিউ সিটির দিকে তাকালে তখন একটা অদ্ভুত দৃশ্য শ্রীধর দেখতে পেতেন। রাতের রাস্তায় ক্রমশ গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, অসংখ্য নেংটি ইঁদুর মুখে মিনি টর্চ কামড়ে ধরে ছুটে চলেছে।
কিন্তু ওরা ছুটে চলেছে কোনদিকে?
কিছু গাড়ি ছুটে যাচ্ছে গেম সিটির দিকে, কিছু গাড়ি ছুটে চলেছে সুপারগেমস কর্পোরেশনের বিল্ডিং-এর দিকে, আর বাকি গাড়ির ঝাঁক ছুটে যাচ্ছে সিন্ডিকেট বিল্ডিং-এর দিকে।
নিউ সিটির বেশ কয়েকটা রাস্তায় গাড়ির ঢলের এই অস্বাভাবিক দৃশ্য পিস ফোর্সের নাইটগার্ডদের নজর এড়ায়নি। তারা খবরটা ফোন করে হেডকোয়ার্টারে জানিয়ে দিচ্ছিল। সেখান থেকে খবর পৌঁছে যাচ্ছিল ওপরের স্তরে, তারপর আরও ওপরের স্তরে, এবং আরও ওপরে…।
শেষ পর্যন্ত সর্ব্বোচ্চ স্তরে—অর্থাৎ, শ্রীধর পাট্টার কানে—খবরটা পৌঁছে গেল। কানে শুধু নয়—চোখেও পৌঁছল। কারণ, ওঁর ঘরের তিনটে টিভিতে তখন এই বিচিত্র ‘কার র্যালি’-র ফুটেজ দেখানো হচ্ছিল।
ব্যাপারটা কী? একটা মানুষের আবেদনে এত মানুষের চঞ্চল হয়ে ওঠার ঘটনা নিউ সিটির ইতিহাসে কখনও ঘটেনি।
এটাকে কি ‘বিপ্লব’ বলা যেতে পারে? কীভাবে কন্ট্রোল করা যায় এই চঞ্চলতা?
•
ওল্ড সিটিতে সেই সময়ে যা ঘটছিল, ওল্ড সিটির ইতিহাসে কখনও সেরকম ঘটেনি।
ওল্ড সিটির হাজার-হাজার মানুষ পাগলের মতো চিৎকার করছে, ‘শ্রীধর পাট্টা, মুর্দাবাদ! জিশান, জিশান, জিন্দাবাদ! শ্রীধর পাট্টা, মুর্দাবাদ!…।’ আর অন্ধকার খানাখন্দে ভরা রাস্তা ধরে তারা হইহই করে ছুটে চলেছে জিশানের বস্তির দিকে। তাদের কারও-কারও হাতে জ্বলন্ত মশাল। মাঝে-মাঝে তাদের কেউ-কেউ আকাশের দিকে চোখ তুলে শুটারবাহিনীর দিকে দেখছে। দেখছে ওদের লেজ থেকে বেরোনো আগুনের হলকা। শুনছে ওদের তীক্ষ্ণ শিস।
জিশানের বস্তির এলাকা তখন ছায়া-ছায়া কালো-কালো মানুষে-মানুষে ছয়লাপ। তাদের সমবেত স্বরে জিশানের জয়ধ্বনি, আর শ্রীধরের নৃশংসতার প্রতিবাদ।
‘শ্রীধর পাট্টা, নিপাত যাক!’
‘আমার ভাই, তোমার ভাই / জিশানকে ফেরত চাই!’
‘নিউ সিটি, মুর্দাবাদ!’
‘ওল্ড সিটি, জিন্দাবাদ!’
‘কিল গেম / শেম-শেম!’
‘কিল গেম, নিপাত যাক! শ্রীধর পাট্টা নিপাত যাক!’
ফেটে পড়া আওয়াজে স্লোগান চলতেই লাগল। রাতের ওল্ড সিটি জনতার রাগী চিৎকারে ফেটে চৌচির হয়ে যেতে লাগল।
শুটারগুলো যখন জিশানের বস্তির কাছাকাছি ল্যান্ড করতে চাইল, তখন ওরা কোনও জায়গা খুঁজে পেল না। রাস্তার ওপরে শুধু মানুষের মাথা আর মানুষের মাথা! আর তারই মাঝে-মাঝে মশালের আলোর এলোমেলো যতিচিহ্ন।