‘নিশ্চয়ই জিশান মাইক্রোইলেকট্রনিক ট্রান্সমিটারটা কোনও না কোনওভাবে অকেজো করে দিয়েছে। তখন জিশান নিশ্চয়ই আমাদের ক্যামেরা নেটওয়ার্কের ”ব্লাইন্ড স্পট”-এ ছিল। তাই টিভিতে ব্যাপারটা আপনাদের আমরা দেখাতে পারিনি। তবে আমাদের মাননীয় মার্শালের কন্ট্রোল রুমে অনেক হাই পাওয়ার ক্যামেরা নেটওয়ার্কের কানেকশান রয়েছে। ফলে জিশানের কীর্তি মাননীয় মার্শালের চোখ এড়ানোর কথা নয়। মার্শালের কন্ট্রোল রুম থেকে ফিডব্যাক পেলেই আমরা সেই পোরশানের—মানে, যে-পোরশানটা আমরা দেখাতে পারিনি—সেটার ভিডিয়ো ফুটেজ আপনাদের দেখিয়ে দেব। জানিয়ে দেব, জিশান কীভাবে কিলারদের ট্র্যাকারকে ফাঁকি দিয়েছে…।’
একটু পরেই জিশান সেই ফুটেজ দেখতে পেল। এবং আরও দেখতে পেল, অগ্নিশর্মা শ্রীধর পাট্টা হিংস্রভাবে পিস ফোর্সের কমান্ডারদের নির্দেশ দিচ্ছেন। বলছেন, এই মুহূর্তে ওল্ড সিটিতে ফৌজ পাঠাতে। সেই ফৌজ জিশানের বউ আর ছেলেকে অ্যারেস্ট করে শুটারে উড়িয়ে দশ মিনিটের মধ্যে নিউ সিটিতে নিয়ে আসবে—শ্রীধর পাট্টার কাছে।
টিভিতে শ্রীধরের পাগল করা চিৎকার শোনা গেল : ‘গো! গো! গো!…গো-ও-ও-ও!’
তারপরই পরদায় ভেসে উঠল ওল্ড সিটির ছবি। ভাঙাচোরা নোংরা পথঘাটের নানান জায়গায় মানুষের ভিড় আর জটলা। সবাই প্লেট টিভিতে কিল গেম দেখছে। এত রাতেও ওল্ড সিটির সব দোকানপাট খোলা—বিশেষ করে খাবারের দোকান। ফুটপাথের এখানে-সেখানে তেলেভাজা, ঝালমুড়ি, শোনপাপড়ি, মালাই বরফ নিয়ে বসে আছে বহু হকার। মাঝে-মাঝেই শোনা যাচ্ছে জনতার উত্তেজনা আর উল্লাসের চিৎকার।
দৃশ্য বদলে গেল।
রাতের আকাশে ছিটকে লাফিয়ে উঠল আটটা শুটার। দুরন্ত গতিতে শুটারবাহিনী ছুট লাগাল ওল্ড সিটির আকাশের দিকে।
জিশানের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। রক্তের অণুতে-অণুতে ঘটে গেল আণবিক বিস্ফোরণ।
ও এরপর যা করল শ্রীধর পাট্টা সেটা ভাবতে পেরেছিলেন কি না কে জানে!
রুকস্যাকে সব গুছিয়ে নিল—হাতে রইল শুধু প্লেট টিভি। তারপর ও ছুট লাগাল।
আলো আর অন্ধকার দাবার ছকের মতো চারপাশে ছড়িয়ে আছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটা পছন্দসই জায়গা খুঁজতে লাগল জিশান। এমন একটা জায়গা যেখানে আলো কটকট করছে—আলোয়-আলোয় জায়গাটা প্রায় দিনের মতো।
দু-তিন মিনিটের মধ্যেই সেরকম একটা জায়গা খুঁজে পেল। তখন লাইটেড জোনের কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে দাঁড়াল। কারণ, ও জানে, এখানে অনেক ক্যামেরা লাগানো আছে। টিভির লাইভ টেলিকাস্ট কোটি-কোটি দর্শক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
সুতরাং এইবার!
জিশানের খালি গা। আলোর তেজে শরীরের ফ্লুওরেসেন্ট রঙের ডিজাইন বেশ ফিকে দেখাচ্ছে। ওর বুকে, হাতে, এখানে-সেখানে রক্তের দাগ। গায়ে ঘামের পরত। তাতে শুকনো পাতার টুকরো-টাকরা লেগে আছে। আর বাঁ-হাতের বাহু গড়িয়ে রক্তের ধারা নামছে।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে গাছের গায়ে লাগানো বেশ কয়েকটা ক্যামেরা নজরে পড়ল। সুতরাং…।
এইটাই ঠিক জায়গা, এইটাই ঠিক সময়।
প্লেট টিভিটা একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে রেখে শূন্যে দু-হাত ছুড়ে দিল জিশান। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে চিৎকার করে কথা বলতে শুরু করল।
‘আমার ওল্ড সিটি আর আর নিউ সিটির ভাই-বোনেরা! কিল গেমের খেলার নিয়মে কোথাও লেখা নেই যে, হাতের মাংস কেটে মাইক্রোইলেকট্রনিক ট্রান্সমিটার খুলে ফেলে দেওয়া যাবে না! নিয়মে এ-কথা বলা নেই যে, কিল গেমে কোনও পার্টিসিপ্যান্ট যদি এই ট্রান্সমিটার খুলে ফেলে খুনিদের ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে তা হলে নিউ সিটির মার্শাল শ্রীধর পাট্টা সেই খেলোয়াড়ের বউ আর ছোট্ট ছেলেকে ওল্ড সিটি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে আসবেন। তারপর তাদের টরচার করার ভয় দেখিয়ে কিল গেমের সেই প্লেয়ারকে ব্ল্যাকমেল করে খতম করার চেষ্টা করবেন।
‘আমার নিউ সিটি আর ওল্ড সিটির বন্ধুরা, আমিই সেই হতভাগ্য প্লেয়ার। ওই দেখুন, আটটা শুটার রওনা হয়ে যাচ্ছে ওল্ড সিটির দিকে—আমার বউ মিনি, আর ছোট্ট ছেলে শানুকে তুলে নিয়ে আসার জন্যে।
‘এতদিন ধরে টিভিতে, রোলার সাইন আর মুভি-বোর্ডে, মার্শাল প্রচার করে এসেছেন যে, কিল গেম ভীষণ ফেয়ার গেম। এই সেই ফেয়ারনেসের নমুনা! এই ফেয়ারনেসের মুখে আমি পেচ্ছাপ করে দিই!’
টিভি সেন্টার তখন দারুণ তৎপরতায় আটটা শুটারকে দেখিয়ে চলেছে। যেন আটটা হানাদার বাজপাখি। শুটারগুলো ওল্ড সিটির আকাশে পৌঁছে গেছে। ওরা একসঙ্গে শিস দিয়ে ধেয়ে চলেছে নীচের দিকে। ওরা নামছে।
সেই ছবিতে জাম্প কাট করে ঢুকে পড়ছে জিশানের চলচ্চিত্র এবং মার্শালের মুখ—শক্ত চোয়াল, কপালে ভাঁজ। আর তার ফাঁকে-ফাঁকে মিনি আর শানুর সুন্দর মিষ্টি ছবি।
‘আমার ওল্ড সিটির বন্ধুরা, আমার নিউ সিটির ভাই-বোনেরা! আপনারা আমাকে ন্যায়বিচার দিন। অবিচারের এগেইনস্টে আপনারা রুখে দাঁড়ান! আপনাদের ঘরেও তো মা, বাবা, বোন, ভাই, ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে রয়েছে। আপনারা এই নোংরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান! আপনাদের কাছে আমি…আমি…আমার বউ আর ছেলের প্রাণভিক্ষা চাইছি। ওদেরকে বাঁচান! আমাকে…আমাকে…সৎভাবে লড়তে দিন! প্লিজ! ওদের বাঁচান! আর কিছু আমি চাই না…কিচ্ছু চাই না…।’