জিশানের কবজিতে বাঁধা কাউন্টডাউন ওয়াচে সময় ক্রমেই জিরো আওয়ারের দিকে এগোচ্ছিল—সেটাই জিশানের একমাত্র আশা-ভরসা-আনন্দ। তবে ও বুঝতে পারছিল, এভাবে পালিয়ে-পালিয়ে লাল ডটজোড়ার হাত থেকে ও বেশিক্ষণ বাঁচতে পারবে না। কিছু একটা ওকে করতে হবে—এবং সেই ‘করা’টা শ্রীধর পাট্টার পছন্দ হোক বা না হোক।
জঙ্গলের মধ্যে ছুটে-ছুটে নতুন একটা আস্তানা খুঁজে পেল। একটা বেঁটে মোটা গাছ। সার্চলাইটের আলো ছিটকে পড়েছে তার গুঁড়িতে, পাতায়। গাছটার গায়ে হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগল। শরীরে আর কতটুকু শক্তি বাকি আছে কে জানে!
রুকস্যাক থেকে হান্টিং নাইফ বের করে নিল। পকেট থেকে স্পার্কার বের করে হান্টিং নাইফের ফলাটা গরম করতে শুরু করল। হ্যাঁ, মাইক্রোট্রান্সমিটারটা এবার শরীর থেকে ও বের করবেই। লাল ডটজোড়ার সঙ্গে সবুজ ডটটা আর লুকোচুরি খেলতে পারছে না।
জিশানের চোয়াল শক্ত হল। যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য তৈরি হল।
বাঁ-হাতের বিশেষ জায়গাটার দিকে তাকাল। ওর শরীরটা হাঁটুর পর থেকে নীচের দিকে পায়ের পাতা পর্যন্ত আলোয় আলো। ওপরদিকটা অন্ধকারে ঢাকা—তবে সে-অন্ধকার আলোর ছটায় কিছুটা ফিকে।
বিশেষ জায়গাটা অনুমান করতে জিশানের খুব একটা অসুবিধে হল না। কিন্তু হান্টিং নাইফের ফলা সেখানে বসাতে না বসাতেই ওর ফোন বাজতে শুরু করল।
শ্রীধর পাট্টার ফোন নিশ্চয়ই।
জিশান গাছের আড়ালে রাখা রুকস্যাকের দিকে তাকাল। কিন্ত স্যাটেলাইট ফোনটা বের করার জন্য একটুও ব্যস্ত হল না। বরং ওর ডানহাত কসাইয়ের কাজ করে চলল।
ও:! আ:! মিনি! শানু!
মিনি আর শানুর কথা ভেবে জিশান যন্ত্রণাটাকে মনে-মনে কমাতে চেষ্টা করল। একইসঙ্গে মাইক্রোট্রান্সমিটারের খোঁজে বাঁ-হাতের মাংস খুঁড়তে লাগল।
একটু পরেই ছুরির খোঁচায় চটচটে আঠালো লাল রঙের তরল মাখা ট্রান্সমিটারটা বেরিয়ে খসে পড়ল মাটিতে। হাতড়ে-হাতড়ে সেটাকে তুলে নিল জিশান। ওটাকে গাছের গুঁড়ির গায়ে চেপে ধরে হান্টিং নাইফের ধারালো ফলার পোচে দু-টুকরো করে দিল।
এখন ওই খুদে যন্ত্রটা কাউকে আর কোনওরকম সিগন্যাল পাঠাতে পারবে না। সুখারাম আর প্রাোটনের ট্র্যাকার থেকে সবুজ ডটটা নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে নিভে গেছে।
আ—আ—:!
যন্ত্রণার মধ্যেও জিশানের বুকে ঠেলে একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ও রুকস্যাক খুলে একটা ‘ফার্স্ট এইড’ প্যাক বের করে নিল। প্যাকের বোতাম খুলে চটপট বের করে নিল একটা কেমিক্যালের গুঁড়ো—’ব্লাড কোয়াগুলেটর’। সেটা একখাবলা তুলে নিয়ে চেপে ধরল বাঁ-হাতের ক্ষতস্থানে। সঙ্গে-সঙ্গে টের পেল, যন্ত্রণা কমতে শুরু করেছে। একটু পরে রক্ত পড়াও বন্ধ হয়ে যাবে।
রুকস্যাকের ভেতরে স্যাটেলাইট ফোন তখনও একঘেয়েভাবে বেজে যাচ্ছিল। শ্রীধর পাট্টা সহজে ক্ষান্ত হওয়ার পাত্র নন।
জিশান যখন ফোন ধরল ততক্ষণে প্রায় দশমিনিট কেটে গেছে। এবং ফোন ধরামাত্রই শোনা গেল শ্রীধর পাট্টার হিংস্র হুঙ্কার।
‘জিশান, য়ু বাস্টার্ড! সন অফ আ বিচ! হাউ ডেয়ার য়ু…!’
জিশান উত্তরে শব্দ করে হাসল : ‘এ ছাড়া আমার আর কোনও পথ নেই রে, শুয়োরের বাচ্চা!’
‘তুই তোর বউ আর ছেলের কথা কি ভুলে গেছিস?’ একটা খিদে পাওয়া বাঘ যেন গর্জন করে প্রশ্নটা করল।
‘না, ভুলিনি—।’
‘ঠিক আছে। তুই যেভাবে খেলতে চাস সেভাবেই খেলব। আমি তোর বউ আর ছেলেকে ওল্ড সিটি থেকে এখুনি তুলে নিয়ে আসছি। তারপর দেখি…তোর পাগলামো বন্ধ করা যায় কি না!’
শ্রীধর হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু জিশান ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে।
ও রুকস্যাক গুছিয়ে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে আবার পথ চলতে শুরু করল। অন্ধকার এলাকা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ও একেঁবেঁকে ছুটতে লাগল। এখন ওর ‘হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’। কারণ, খুনিদের ট্র্যাকারে আর কোনও সবুজ ডট নেই। আর টিভির কমেন্টেটররা কখনও ওর পজিশন কো-অর্ডিনেট কমেন্ট্রিতে বলবে না। সেটাই নিয়ম। তবুও শ্রীধর যদি ওদের নিয়ম ভাঙতে বলেন, তা হলে আর-এক মুশকিল। কারণ, লক্ষ-হাজার ক্যামেরার নম্বর আর লোকেশন চেক করে, সেখান থেকে জিশানের পজিশন কো-অর্ডিনেট ব্লক কম্পিউট করে, রানিং কমেন্ট্রিতে বলতে-বলতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যাবে—ততক্ষণে জিশান হয়তো অন্য কোথাও ছিটকে যাবে। তা ছাড়া কমেন্টেটররা এত টেকনিক্যাল কারিকুরিতে অভ্যস্ত নয়। ফলে ওরা খুনিদের সাহায্য করার বদলে বিভ্রান্ত করবে, এই সম্ভাবনাটাই বেশি।
সুতরাং, হাতে বেশ যন্ত্রণা হলেও জিশানের নিজেকে এখন ‘স্বাধীন’ মনে হচ্ছিল।
একটা ঘন গাছগাছালির অন্ধকারে আস্তানা গেড়ে প্রথমে ট্র্যাকার খুলল জিশান। শুধুমাত্র দুটো লাল ডট ট্র্যাকারের মানচিত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে ওরা যে ঠিক কোথায় সেটা বোঝা গেল না। আর সবুজ ডট থেকে ওদের দূরত্বই বা কত কে জানে!
এই অসুবিধেটার কথা জিশান ভাবেনি।
একটু পরেই টিভি খুলল।
‘…স্টানিং নিউজ, ফোকস। কিলারদের ট্র্যাকার থেকে জিশান পালচৌধুরী হারিয়ে গেছে। ওই দেখুন—প্রাোটনের ট্র্যাকার! স্ক্রিনে কোনও গ্রিন ডট নেই! এবার দেখুন কিলার সুখারামের ট্র্যাকার—নো গ্রিন ডট। তা হলে তো কিলার দুজন এখন অন্ধ! ওরা জিশানকে কী করে ট্র্যাক করবে কে জানে!