অন্ধকার নেমে আসার পর আরও একটা ঘটনা ঘটল গেম সিটিতে: গেম সিটির নানান জায়গায় জোরালো আলোর বন্যা বয়ে গেল—রাস্তায়, মাঠে-ঘাটে, নদীর দু-পাড়ে, ফ্লাইওভারে, পাহাড়ে, এমনকী জঙ্গলেও।
তবুও তারই মধ্যে জিশান ছোটখাটো ছায়ার আড়াল খুঁজতে লাগল।
ও জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দেখল, দু-একটা জন্তু-জানোয়ার উদভ্রান্তের মতো ছুটে পালাচ্ছে অন্ধকার অঞ্চলের দিকে।
জিশান একটা ছোট্ট আঁধারি অঞ্চল বেছে নিল। তারপর রুকস্যাক পিঠে ঝোলানো অবস্থায় একটা ঝুপসি গাছ বেয়ে উঠতে শুরু করল।
অনেকটা ওপরে ওঠার পর ও একটা শক্তপোক্ত ‘ওয়াই’-এর মতো ডালের খাঁজ খুঁজে পেল। শরীরটাকে ভাঁজ-টাজ করে মানিয়ে সেই খাঁজে জুত করে বসল। রুকস্যাক থেকে বের করে নিল ট্র্যাকার আর প্লেট টিভি।
জঙ্গলের বুনো গন্ধ জিশানের নাকে ঝাপটা মারছিল। কানে আসছিল পাখির ডাক, অজানা পশুর ডাক। আর সব ছাপিয়ে ঝিঁঝির ডাক।
ট্র্যাকার দেখল জিশান। লাল ডট দুটো সবুজ ডটের কাছ থেকে খুব বেশি দূরে নেই। কিন্তু জিশান কী করবে? এই ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে আর কত দৌড়বে? সাংঘাতিক খিদে না পেলে ও কখনও ফুড পয়েন্টের খোঁজে যায়নি। একটু আগেই ও ফুড পয়েন্ট থেকে খেয়ে নিয়েছে। তার সঙ্গে পেট ভরে জল খেয়েছে। ঘাড়ে মাথায় ভালো করে জল দিয়েছে। আশায়-আশায় বারবার ভেবেছে, রাত পোহালেই লড়াই শেষ। তখন ওর, মিনির আর শানুর জীবনে সত্যিকারের ভোর আসবে।
কিন্তু এই গাছে ও কতক্ষণ লুকিয়ে থাকবে? লাল ডটগুলো আরও কাছে এগিয়ে এলে ও তখন বরং গাছ পালটে নেবে। কিংবা ভেবে-টেবে যা হোক কিছু করবে।
ট্র্যাকার রেখে প্লেট টিভি অন করল জিশান। ভলিয়ুম খুব কমিয়ে দিল। দেখল, টিভিতে ও আর সংগ্রামজিতের বৃদ্ধ বাবা। তার সঙ্গে ধারাভাষ্য চলছে। আর মাঝে-মাঝে জাম্প কাট করে ঢুকে পড়ছে সংগ্রামজিতের কিল গেমের ক্লিপিংস।
একটু পরেই বৃদ্ধের মুখের ক্লোজ আপ দেখা গেল। জিশানের মনে হল, বৃদ্ধ যেন ঘোলাটে চোখ মেলে সরাসরি ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন।
•
টিভি অফ করে নিজের দিকে তাকাল জিশান।
ও লুকোবে কী! ওর সারা গায়ে রঙিন আলোর নকশা জ্বলজ্বল করছে। এরকম ‘ব্রাইট টারগেট’ একজন কালার ব্লাইন্ড শুটারও মিস করবে না। আর সুখারাম এবং প্রাোটন তো সুপারকিলার!
হঠাৎ জিশানের মনে হল টি-শার্টটা খুলে ফেললে কেমন হয়! তা হলে অন্তত রঙের রোশনাইয়ের হাত থেকে বাঁচা যাবে। তারপর প্যান্টের পালা।
টি-শার্টের বুকপকেট থেকে মিনি আর শানুর ফটোটা বের করে নিল। অন্ধকারে ওদের মুখ দেখা যাচ্ছিল না। তাই একটা লম্বা শ্বাস ফেলে প্যান্টের কোমরের পটি টেনে ঢিলে করে জাঙিয়ার ইলাস্টিকের পিছনে ফটোটা চালান করে দিল। এটাই এখন সবচেয়ে সেফ জায়গা।
তারপর রুকস্যাক থেকে হান্টিং নাইফ বের করে টি-শার্টের চার-পাঁচ জায়গায় লম্বা করে ছুরি টেনে দিল। হাতের কয়েক টানে টি-শার্টের খোসা চটপট ছাড়িয়ে ফেলল। কাপড়ের ছেঁড়া টুকরোগুলো ছুড়ে দিল অন্ধকারের দিকে।
কিন্তু একইসঙ্গে জিশান চমকে উঠল।
ফুল স্লিভ টি-শার্টের নীচে ওর আর কোনও পোশাক ছিল না। ও অবাক হয়ে দেখল, ওর গায়ে ঠিক জামাটার মতোই ফ্লুওরেসেন্ট রঙের জ্বলজ্বলে ডিজাইন আঁকা। টি-শার্টটা ও না ছিঁড়ে ফেললেই পারত। কিন্তু এই নকশা ওর গায়ে কে, কখন আঁকল? কেউ তো আঁকেনি!
শ্রীধর পাট্টা বোধহয় জিশানের দিকে লক্ষ রাখছিলেন, মজা দেখছিলেন। কারণ, তখনই জিশানের স্যাটেলাইট ফোন বেজে উঠল।
ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে নিষ্ঠুরতার হিংস্র কারিগর বলে উঠলেন : ‘সারপ্রাইজ, জিশান—আবার সারপ্রাইজ…।’
জিশান চুপ করে রইল। ওর অবাক ভাবটা তখনও কাটেনি।
‘শোনো, জিশান / এই রঙের ফান। এই রঙে আঁকা ড্রেস এক ঘণ্টা গায়ে দিয়ে থাকলেই তোমার বডি টেম্পারেচারে রঙের কেমিক্যালটা অদ্ভুত এক রিয়্যাকশন ইনিশিয়েট করে তোমার ড্রেসের ফ্যাব্রিক চুঁইয়ে তোমার গায়ে চলে যাবে। তোমার পোশাকের নকশার ফোটোকপি এঁকে দেবে তোমার চামড়ায়।’ হাসলেন : ‘এক্সট্রিমলি সুপার-সারপ্রাইজিং টেকনোলজি—তাই না?’
জিশান চুপচাপ ভাবছিল। তাই শ্রীধরের কথাবার্তার সময় একটুকরো জবাবও দিচ্ছিল না। এখন ওর সামনে আর কী-কী পথ খোলা রয়েছে সেটাই চিন্তা করছিল। আধো-আঁধারিতে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে নিজেকে রঙিন উলকি আঁকা আদিবাসী বলে মনে হচ্ছিল।
‘থ্যাংক—ইউ—মার্শাল।’ কাটা-কাটা সুরে বলল জিশান এবং ফোন রিসেট করে দিল।
জিশান বুঝতে পেরেছিল, খানিকক্ষণ পরপরই ওকে লুকোনোর জায়গা পালটাতে হবে। তবে ও জঙ্গলের মধ্যেই থাকতে চায়—খোলা জায়গায় যেতে চায় না। কারণ, খোলা জায়গায় গেলে ওর একটা বাহন দরকার—গাড়ি কিংবা মোটরবাইক। সেটা কীভাবে খুঁজে পাবে ও জানে না। গেম সিটিতে এখন কোথাও আলো, কোথাও অন্ধকার।
গাছ থেকে নেমে পড়ল জিশান। জঙ্গলের মধ্যে এখানে-ওখানে ছুটোছুটি করে আস্তানা পালটাতে লাগল। কখনও গাছের ওপরে, কখনও ঝোপঝাড়ের আড়ালে, কখনও বা এবড়োখেবড়ো পাথর কিংবা ঢিবির খাঁজে।
উড়ন্ত জোনাকির আলো ওর চোখে পড়ছিল। চোখে পড়ছিল জোড়া-জোড়া জ্বলন্ত সবুজ চোখ।
নানান জায়গায় আলো জ্বলে ওঠায় জঙ্গলটা ভারী অদ্ভুত লাগছিল। দুটো লাইটেড জোনের মাঝামাঝি জায়গাটা অনেক বেশি গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা বলে মনে হচ্ছিল।