ঠিক তখনই পাশের বাড়ি থেকে টিভির কথাবার্তা শুনতে পেল। দোতলার একটা জানলা দিয়ে উঁকি মেরে পাশের বাড়ির খোলা জানলা দিয়ে একটা ঘরের ভেতরে নজর চালাল জিশান। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।
তখন ও চটপট সিঁড়ি নেমে রওনা হল পাশের বাড়ির দিকে।
নতুন বাড়িটায় ঢুকে এ-ঘর ও-ঘর খোঁজ করে কাউকে না পেয়ে জিশান উঠে গেল দোতলায়। টিভির শব্দ লক্ষ্য করে পৌঁছে গেল একটা ঘরে।
ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল।
আশি কি নব্বই বছর বয়েসি একজন অতি বৃদ্ধ মানুষ একটি আরাম-চেয়ারে বসে রঙিন টিভির পরদার দিকে তাকিয়ে আছেন। ফরসা মানুষটার চোখে কোনও চশমা নেই। মাথায় অল্পবিস্তর টাক—বাকিটা শোনপাপড়ির আঁশের মতো লম্বা-লম্বা চুল। গালে আর থুতনিতে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। গায়ের চামড়া গিলে করা। পরনে একটা সাদা কুর্তা আর ছাই রঙের পাজামা।
জিশান ঘরে ঢোকার সময় দরজায় শব্দ হয়েছিল। বৃদ্ধ টিভি থেকে চোখ সরিয়ে জিশানের দিকে তাকালেন। কাঁপা গলায় বললেন, ‘এসো, জিশান…।’
জিশান ঘরের ভেতরে দু-পা ঢুকে জিগ্যেস করল, ‘বাড়িতে আর কেউ নেই?’
‘না, নেই। আমি একা—ভীষণ একা।’ একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মানুষটা : ‘তুমি হঠাৎ এলে। আমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে…।’ একটু চুপ করে থেকে ডানহাতের ইশারায় একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ‘একটু বোসো ওখানে—।’
কী যে হল জিশানের—বৃদ্ধের অনুরোধ ফেলতে পারল না। হঠাৎ বাবার মুখটা ভেসে উঠল সামনে। ও চেয়ারটায় বসে পড়ল। মিসাইল গানটা পকেটে ঢুকিয়ে নিল।
তারপর অবাক হয়ে বলল, ‘ফাঁকা বাড়িতে আপনি একা-একা বসে টিভি দেখছেন!’
‘দেখছি আর কোথায়! শুনছি—’ করুণ হাসলেন : ‘আমি চোখে দেখতে পাই না। ছানি…ছানি…।’
জিশান বৃদ্ধকে দেখছিল। দুটো চোখের মণিই ঘোলাটে—যেন চোখের মণির ওপরে মাছের আঁশ বসানো। চোখের কোণে পিচুটি। ওপরের ঠোঁট বসে গেছে ভেতরে। বোধহয় ওপরের পাটির সামনের কয়েকটা দাঁত নেই। দুটো ঠোঁটই থরথর করে কাঁপছে। ঠোঁটের একপাশ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে।
লক্ষ করল, ওর চেয়ারের পাশে একটা ছোট টেবিলে অনেক ওষুধপত্র।
জিশান জিগ্যেস করল, ‘আপনার এত বয়েস! চোখে দেখতে পান না! তা সত্বেও গেম সিটিতে মক সিটিজেন হয়ে এসেছেন!’ একটু থেমে তারপর : ‘যদি আপনার কোনও বিপদ-আপদ হয়!’
হাসলেন বৃদ্ধ। কয়েকটা দাঁত দেখা গেল। কয়েকটা নেই। খসখসে কাঁপা গলায় বললেন, ‘আমার তিন কুলে আর কেউ নেই। এই বয়েসে তাই আমার আর কোনও ভয় নেই। তা ছাড়া…তা ছাড়া…আমার ছেলে সংগ্রামজিৎ—আমার বৃদ্ধ বয়েসের ছেলে—এই কিল গেমে হেরে গিয়েছিল। শেষ সংগ্রামটায় আর জিততে পারেনি বেচারা…।’ কিছুক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইলেন। তারপর : ‘কিল গেমের আগে অনেকগুলো গেমের রাউন্ড জিতেছিল সঙ্গু—সঙ্গু ওর ডাকনাম।’
‘আপনি…আপনি কি ওল্ড সিটিতে থাকতেন?’
‘হ্যাঁ—’ ধীরে-ধীরে ওপরে-নীচে মাথা নাড়লেন। কাশলেন দুবার। ঘোলাটে দু-চোখ মেলে জিশানের চোখে তাকালেন : ‘সংগ্রাম হেরে যেতেই ওর মা চোখ বুজল—ধাক্কাটা নিতে পারল না। ফলে সংসারে আমি একা হয়ে গেলাম। সে বহুদিন আগের কথা…।
‘সংগ্রামের পাওয়া প্রাইজ-মানি নেহাত কম ছিল না। তাই একা আমি একটা ডিসিশান নিলাম—নিউ সিটির ইকনমিক ইনডেক্সের পাঁচিল ডিঙিয়ে গেছি বলে ওল্ড সিটি ছেড়ে এখানে চলে এলাম। তারপর থেকে প্রত্যেকটা কিল গেমে আমি মক সিটিজেন হয়ে পার্টিসিপেট করি। একটা নিরিবিলি ফাঁকা বাড়ি দেখে তাতে ঢুকে পড়ি। আর সঙ্গুর কথা ভাবি…’ বৃদ্ধ কথা বলতে-বলতে হাঁপাচ্ছিলেন : ‘আমি…আমি এই…গেম সিটির সিনিয়ারমোস্ট সিটিজেন…।’
জিশান বৃদ্ধের কথা শুনছিল আর মাঝে-মাঝেই টিভির দিকে তাকাচ্ছিল। টিভিতে কমেন্টেটররা জিশানের লোকেশনের কথা বলছিল। আর এও বলছিল যে, দুজন কিলার ক্রমশ জিশানের কো-অর্ডিনেটের দিকে এগিয়ে আসছে।
সুতরাং হাতে আর খুব বেশি সময় নেই।
জিশান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সূক্ষ্ম শব্দ হলেও বৃদ্ধ সেটা টের পেলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে…তোমাকে তো আবার…ছুটতে হবে।’
চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। জিশানের কাছে এগিয়ে আসতে-আসতে বললেন, ‘সঙ্গু খুব চেষ্টা করেছিল…কিন্তু পারেনি। আমার খুব আশা…কেউ না কেউ পারবে। এই বয়েসে মরার ভয় করি না। তাই…আশায়-আশায় আসি…।’
আন্দাজে ভর করে জিশানের গায়ে হাত দিলেন বৃদ্ধ। সেখান থেকে হাতড়ে-হাতড়ে ওর মুখে চলে গেলেন। তারপর ওর চিবুকে আঙুল ছুঁইয়ে কাঁপা গলায় বললেন, ‘সঙ্গু, এবার তোকে জিততেই হবে! মনে থাকে যেন…।’
জিশান বৃদ্ধকে দেখছিল। ভাঁজে-ভাঁজে ঝুলে পড়া চামড়ায় তৈরি এক প্রাগৈতিহাসিক মূর্তি। সেই মূর্তির ছানি পড়া চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
জিশান আলতো গলায় বলল, ‘চেষ্টা করব…খুব চেষ্টা করব…।’ তারপর পকেট থেকে মিসাইল গান বের করে খোলা দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল।
আবার পথ চলা। তবে আশার কথা, সূর্য এখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। একটু পরেই নেমে আসবে অন্ধকার। প্রিয়তম অন্ধকার।
•
অন্ধকার যখন জিশানকে কালো চাদরে জড়িয়ে নিল তখন জিশান নতুন করে আবার অবাক হল। ওর গায়ের ফুল স্লিভ টি-শার্ট আর প্যান্টের কালো কাপড়ের ওপরে জ্বলজ্বল রঙিন রেখায় ফুটে উঠেছে নানান হিজিবিজি নকশা। এরকম লুকোনো ফ্লুওরেসেন্ট কালারের কথা জিশান কখনও শোনেনি। এটা শ্রীধর পাট্টার আরও একটা সারপ্রাইজ। অন্ধকারের মধ্যেও জিশানকে তাক করে গোলাগুলি ছুড়তে প্রাোটন বা সুখারামের কোনও অসুবিধে হবে না। আর জিশান শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত যে, প্রাোটন এবং সুখারামের পোশাকে এরকম কোনও হিডন ফ্লুওরেসেন্ট কালারের নকশা নেই।