গাড়িটার কাছে পৌঁছে জিশান মোটরবাইকের স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নেমে পড়ল গাড়ির বনেটের ওপরে। তারপর সেখান থেকে বাইকের চাকা লাফিয়ে-লাফিয়ে রাস্তায়। তারপর জিশানের বাইক স্বচ্ছন্দে ছুটে চলল।
একটু ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে বাইক থামল। বাঁ-দিকে অনেকটা ফাঁকা জমি। তার পরেই একটা বিশাল জলা। এদিক-ওদিক তাকালে চোখে পড়ে বেশ কয়েকটা বড়-বড় গাছ।
বিকেলের ঢলে পড়া আলোয় জায়গাটা কী সুন্দর, শান্ত আর নির্জন!
রুকস্যাক থেকে ট্র্যাকার বের করে দেখল জিশান। দুটো লাল ডটই এখন নড়ছে। তার মানে, কিলার প্রাোটন জ্ঞান ফিরে পেয়েছে।
ইস, এই ট্র্যাকারটা যদি না থাকত।
তা হলে জিশান ওই জলার মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে লুকিয়ে থাকত। সুখারাম আর প্রাোটনের চোখে ধুলো দিয়ে রাত কাবার করে দিত।
হঠাৎই ওর মাথায় একটা নতুন চিন্তা খেলে গেল : ওর বাঁ-হাতের যে-জায়গায় শ্রীধর পাট্টার মেডিকরা অপারেশন করে মাইক্রোট্রান্সমিটারটা ঢুকিয়ে দিয়েছে, সে-জায়গার মাংস খুবলে ট্রান্সমিটারটাকে বের করে এখানকার জমিতে কোথাও পুঁতে দিলে হয় না! তা হলে দুই কিলারের ট্র্যাকারে দেখাবে জিশান এখানেই কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রয়েছে, অথচ জিশান তখন এখান থেকে অনেক দূরে কোনও নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।
সুতরাং বাইক থেকে নেমে পড়ল জিশান। রুকস্যাকে ট্র্যাকার রেখে দিয়ে বের করে নিল হান্টিং নাইফ। আর প্যান্টের পকেট থেকে বের করল স্পার্কার। এর বোতাম টিপলেই ছিটকে বেরোবে আগুনের নীল শিখা।
স্পার্কার অন করে হান্টিং নাইফের ইস্পাতের ফলাটা ও গরম করতে শুরু করল। শরীরে ঢোকানোর আগে ছুরির ফলাটাকে স্টেরিলাইজ করে নেওয়া দরকার।
জিশান চারপাশে একবার তাকাল। তারপর বাইকের পাশে রাস্তায় বসে পড়ল। ডানহাতে ছুরিটা বাগিয়ে ধরে বাঁ-হাতটা উঁচিয়ে ধরল চোখের সামনে। অপারেশন করে ট্রান্সমিটার ঢোকানোর জায়গাটা জিশানের স্পষ্ট মনে আছে। এই তো! এই জায়গাটায়! টি-শার্টের কালো চকচকে সিনথেটিক মেটিরিয়ালের ঠিক পিছনেই।
টিভির লাইভ টেলিকাস্টে জিশানকে কি এখন দেখা যাচ্ছে? কেউ কি বুঝতে পেরে গেছে ওর প্ল্যান?
এমন সময় জিশানের স্যাটেলাইট ফোন বেজে উঠল।
ফোনের আওয়াজে জিশান চমকে উঠল। ওর ছুরি ধরা হাত থমকে গেল। বাঁ-হাত এগিয়ে গেল বাইকে রাখা রুকস্যাকের দিকে।
ফোন বের করে কলটা রিসিভ করতেই চেনা গলা শোনা গেল।
‘বাবু জিশান, কোনও দুষ্টুমি কোরো না।’ খুকখুক হাসি : ‘তা হলে আমাকেও দুষ্টুমি করতে হবে—।’
‘আমি…মানে…।’
‘হ্যাঁ, জানি। তুমি গরম হান্টিং নাইফ দিয়ে বগল চুলকোতে যাচ্ছিলে।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর : ‘আমি ওল্ড সিটিতে ফোর্স পাঠাচ্ছি—তোমার বউ আর ছেলেটাকে নিউ সিটিতে তুলে আনার জন্যে। ওরা হবে আমার সিকিওরিটি ডিপোজিট। তোমার কোনও দুষ্টুমি দেখলেই আমি ওদের নিয়ে অল্পস্বল্প দুষ্টুমি করব…।’
শ্রীধরের ঠান্ডা গলা শুনে জিশানের হাত থেকে হান্টিং নাইফ পড়ে গেল। ওর গলা চিরে একটা যন্ত্রণার চিৎকার বেরিয়ে এল, ‘না! না! আমার ওয়াইফ আর ছেলেকে আপনি টাচ করবেন না। প্লিজ! প্লিজ…!’
ততক্ষণে শ্রীধর ফোনের লাইন কেটে দিয়েছেন।
জিশান কয়েক সেকেন্ড হাঁটুগেড়ে বসে রইল। ওর চোখে জল এসে গেল। শ্রীধর পাট্টা ওর সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় ঘা দিয়েছেন। শালা, বাস্টার্ড!
হঠাৎই জিশানের খেয়াল হল, লাইভ টেলিকাস্টে দর্শকরা ওর চোখের জল দেখতে পাচ্ছে। ও তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল। হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নিল। চটপটে ভঙ্গিতে হান্টিং নাইফ রুকস্যাকে ঢুকিয়ে বাইকে চড়ে বসল।
বাইক চালাতে-চালাতেই টের পেল, ইঞ্জিনের আওয়াজ ছাপিয়ে ওর বুকের ভেতরে ধকধক শব্দ শোনা যাচ্ছে। এইরকম একটা সময়ে মিনি আর শানুর কথা তুলে শ্রীধর পাট্টা সত্যি-সত্যি ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন।
ঝকঝকে মসৃণ রাস্তায় বাইকের চাকা পিছলে যাচ্ছিল—লাল ডট দুটোর কাছ থেকে দূরে, আরও দূরে। রাস্তার দুপাশে গাছপালা আর উঁচু-নীচু প্রান্তর। জিশানের ক্লান্ত লাগছিল। শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় জ্বালা করছিল। মুখে, হাতে ধুলোর আস্তর—তার সঙ্গে ঘাম। ও বেশ বুঝতে পারছিল, এখন ওর একটু বিশ্রাম দরকার।
হঠাৎই ওর চোখে পড়ল, দূরে রাস্তার ধারে দুটো বাড়ি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুটো বাড়িই দোতলা। একটা হালকা ছাই রঙের, আর তার পাশেরটা আবছা নীল। বাড়ি দুটো তীব্র গতিতে ক্রমশ ওর কাছে এগিয়ে আসছে।
জিশান লক্ষ করল, বাড়ি দুটোর বারান্দা কিংবা জানলায় কোনও উৎসুক মানুষের ভিড় নেই। ব্যাপারটা ওকে একটু অবাক করল। গেম সিটির কোনও মক সিটিজেন কি এ-দুটো বাড়িতে নেই?
জিশানের বাইক বাড়ি দুটোর সামনে এসে দাঁড়াল। বাড়ির একতলার দুটো দোকানঘর খাঁ-খাঁ করছে। জানলা আর বারান্দাও তাই।
জিশান বাইকটা একটা দোকানঘরে ঢুকিয়ে আড়ালে দাঁড় করাল। রুকস্যাক পিঠে নিল। বাইকের কেরিয়ার থেকে তুলে নিল ট্র্যাকার। তারপর মিসাইল গান হাতে বাগিয়ে ধরে খুব সাবধানে ধীরে-ধীরে পা ফেলে ঢুকে পড়ল একটা বাড়িতে।
বাড়িটার সবক’টা ঘর ঘুরে দেখল। আশ্চর্য! বাড়িতে কেউ নেই!
এই বাড়িটায় কোনও মক সিটিজেন নেই কেন? অপটিক্যাল ট্যাবলেট থেকে বাড়িটার লোকেশন দেখল। গেম সিটির পশ্চিম প্রান্তের দিকে। হয়তো মক সিটিজেনের তুলনায় বাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। তাই পশ্চিমদিকের এই দুটো বাড়ি সুনসান—খাঁখাঁ।