কারণ একটাই : গেম সিটির সীমানার মধ্যে ওকে জিশানকে শিকার করতে হবে।
এইখানেই হয়েছে যত মুশকিল!
কিল গেমে নামার আগে জিশানের নানান গেমের ক্লিপিংস সুখারাম দেখেছে। দেখেছে ওর আরও অন্যান্য ক্লিপিংস। সেইসব দেখার পর থেকেই ওল্ড সিটির এই লড়াকু ছেলেটার প্রতি ওর শ্রদ্ধা বেড়ে গেছে। বারবার মনে হয়েছে, জিশান ওর ভাই—ওরা একই শহরে মানুষ হয়েছে। এই নিউ সিটিতে আসার পর থেকে জিশান ওর শহরের হয়ে লড়াই করছে, ন্যায়ের হয়ে লড়াই করছে।
সুখারামের মনে পড়ল, মনোহর সিং-এর হয়ে জিশান রুখে দাঁড়িয়েছে, জাব্বাকে পিট ফাইটে নিকেশ করতে-করতেও ও ছেড়ে দিয়েছে, অন্যায়ের সঙ্গে কখনও আপস করেনি।
এসব কথা ভাবতে-ভাবতে সুখারামের মনের ভেতরে শ্রীধর পাট্টার মুখটা বদনোয়ার মতো হয়ে গেল, আর জিশানের মুখটা ওর মতো। সুখারামও তো ন্যায়ের জন্যই লড়াই করেছিল!
সুখারাম যদি জিশানকে খতম করতে পারে তা হলে তার বিনিময়ে ও কী পাবে? মৃত্যুদণ্ড রদ। সেইসঙ্গে মুক্তি। আর হয়তো অনেক টাকা পুরস্কার। কিন্তু সেগুলো নিয়ে ও করবে কী? কোথায় যাবে? মা নেই। চোলিও নিশ্চয়ই আর নেই। তা হলে ও যাবে কোথায়? অনিশ্চিত জীবনের পথে শুধু দৌড়বে, আর দৌড়বে!
বরাট স্যারের কথা মনে পড়ল। স্যারের খদ্দরের পাঞ্জাবি থেকে ঘামের গন্ধ ভেসে এল ওর নাকে। স্যার প্রায়ই বলতেন, ‘তুই একদিন বড় কিছু একটা করে দেখাবি….।’ বদনোয়া আর ওর চারটে চুন্নুকে খতম করে ও পৃথিবী থেকে পাঁচ-পাঁচটা পাপীকে মুক্তি দিয়েছিল। একটা ‘বড়’ কাজ করে দেখিয়েছিল।
আজ আবার একটা সুযোগ এসেছে—একটা ‘বড়’ কিছু করে দেখানোর। তাই ও শ্রীধরের পোষা অন্ধ কুকুরের মতো জিশানকে তাড়া করে ছুটে বেড়াতে পারছিল না। ওর ভেতরে ভীষণ তীব্র একটা অনিচ্ছার ঝোঁক কাজ করছিল। তাই সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে ওর আর জিশানের মধ্যে দূরত্বের ফারাক তেমন একটা কমছিল না।
এর জন্য বেশ কয়েকবার শ্রীধর ওকে ফোন করে ধমক দিয়েছেন : ‘কী ব্যাপার, সুখারাম? তুমি কি ভুলে গেলে তোমার ফেরোসিটি কোশেন্ট 8.9? তোমার অ্যাক্টিভিটি দেখে তো মনে হচ্ছে ওটা 2.5-এরও কম!’
শুধু শ্রীধর পাট্টা নয়, টিভির কমেন্টেটররাও ওকে ঘন-ঘন সমালোচনা করেছে। ও গেম সিটির কয়েকটা দোকানে দাঁড়িয়ে দোকানের টিভিতে নিজের কানে সেইসব সমালোচনা শুনেছে। কমেন্টেটররা কখনও ওকে ‘সুখী সুখারাম’ বলে সম্বোধন করেছে, আবার কখনও বা বলেছে, ‘ওর নাম মনে হয় সুখারাম নস্কর নয়, সুখারাম গদাইলশকর!’
কিন্তু না—তাতেও সুখারামের ভেতরের ইচ্ছেটা, কিংবা অনিচ্ছাটা, পালটায়নি। কিল গেমটা ও জিশানের সঙ্গে লড়তে চায় না, শ্রীধরের সঙ্গে লড়তে চায়। ওর আবার একটা ‘বড়’ কাজ করে দেখাতে ইচ্ছে করছে। বরাট স্যার যেখানেই থাকুন, নিশ্চয়ই ওর এই কাজের কথা জানতে পারবেন।
ওর নাকে স্যারের ঘামের গন্ধটা আবার ভেসে এল।
জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল সুখারাম। হাতে ধরা হাই-ফাই ইলেকট্রনিক ট্র্যাকার। একটা সবুজ ডট, আর দুটো লাল ডট। সবুজ ডটটা নড়ছে বটে, কিন্তু লাল ডট দুটো স্থির।
অপাশি যে আর নেই সেটা সুখারাম জানে। সুতরাং দুটো লাল ডটের একটা ও নিজে, আর অন্যটা প্রাোটন। সুখারাম চুপচাপ একজায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাই ওর লাল ডট স্থির। কিন্তু প্রাোটনও কি তা হলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে! কিন্তু কেন?
প্রাোটনকে ফোন করল সুখারাম। রিং বাজতে শুরু করল। অনেকক্ষণ ধরে বাজতেই থাকল—কেউ ধরল না। অবশ্য ধরলেও প্রাোটন এত কম কথা বলে যে, সেগুলোকে ‘কথা’ না বলে ‘হু-হাঁ’ গোছের ‘শব্দ’ বলাই ভালো।
ফোন কেটে দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। গাছপালার পাতার ফাঁক দিয়ে খানিকটা আকাশ দেখা যাচ্ছে। সন্ধে নেমে আসতে আর খুব বেশি দেরি নেই—অন্তত আকাশ তাই বলছে। একটা হেলিকপ্টার আকাশ চিরে উড়ে গেল। ওটার ‘ভোমরার ডাক’ হালকাভাবে ভেসে এল।
সুখারাম এবার নড়েচড়ে উঠল। ছল-ছুতোয় ও অনেক সময় ‘নষ্ট’ করেছে। আরও বেশিরকম গা ঢিলে দিলে শ্রীধর পাট্টা হয়তো তিতিবিরক্ত হয়ে শুটারে করে রিপ্লেসমেন্ট কিলার পাঠিয়ে দেবেন।
সুখারাম জঙ্গলের বাইরে পা চালাল। কাছেই পিচের রাস্তা। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর সোনালি রঙের হাই-স্পিড অটোমোবিল। চ্যাপটা, ছ’চাকাওয়ালা। আগের নীল গাড়িটা সুখারাম বদলে নিয়েছে।
গাড়িতে বসে ইঞ্জিনে স্টার্ট দিল সুখারাম নস্কর। শেষ পর্যন্ত যা-ই হোক না কেন, জিশানের সঙ্গে ওর দেখা হওয়াটা দরকার—ভীষণ দরকার।
•
জিশান বাইক থামাল মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। ও প্যাসকোর কথা ভাবল। ভাবল রুপোলি গাড়ির ‘পাঁচিল’ ডিঙোনোর একটা স্ট্র্যাটেজির কথা। তারপর বাইকে আবার স্টার্ট দিল। এবং ওই ‘পাঁচিল’ লক্ষ্য করেই গোঁ-গোঁ করে বাইক ছুটিয়ে দিল।
কিছুটা পথ গিয়েই বাইক তুলে দিল পাহাড়ের ঢালে। এবড়োখেবড়ো জমি, বড়-বড় ঘাস আর আগাছা, সঙ্গে ছোট-বড় পাথর—তার ওপর দিয়েই ওর বাইক কোলাব্যাঙের মতো লাফাতে-লাফাতে ছুটে চলল। পাহাড়ের ঢালে বাইকটা হেলে থাকলেও ওটার স্পিড মাধ্যাকর্ষণের টানের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। জিশানের বারবার মনে পড়ছিল প্যাসকোর কথা : গেম সিটিতে মোটরবাইকটা একটা অস্ত্র। এখন জিশান সেই অস্ত্র ব্যবহার করছে।