জিশান এত সব কাণ্ড দেখার জন্য মোটেই অপেক্ষা করেনি। মসৃণ পাথরটা শক্রকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ও বুঝতে পেরেছিল লক্ষ্যভেদ হবেই। নিউ সিটির সুদীর্ঘ ট্রেনিং ওর আত্মবিশ্বাসকে অকল্পনীয় ভিতের ওপরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই ও ঘুরে দাঁড়িয়েছে পাহাড়ের ঢালের দিকে। তারপর শুধু হাতে রক ক্লাইম্বিং শুরু করে দিয়েছে। মাকড়সার মতো তরতর করে বেয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে।
ও জানে, প্রাোটনের হাতে এই মুহূর্তে কোনও লং ডিসট্যান্স অস্ত্র নেই। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে মোটরবাইকের কাছে পৌঁছতে হবে। জলদি! জলদি!
প্রাোটন চাতাল থেকে প্রায় দশ-বারো ফুট নীচে পড়ে গিয়েছিল। ওর মাথা ঠুকে গিয়েছিল একটা বড় বোল্ডারে। ওর শরীরটা সেই বোল্ডারের খাঁজে আটকে গিয়ে ওর প্রাণ বাঁচাল বটে, কিন্তু ও অজ্ঞান হয়ে গেল। ওর চোখের আইগিয়ার আশ্চর্যভাবে বেঁচে গেছে—তাতে এতটুকু চিড় ধরেনি। তাই চিত হয়ে পড়ে থাকা প্রাোটনকে বিকেলের রোদে ভারি বিচিত্র দেখাচ্ছিল। ওর দুটো কালো ‘চোখ’ নিষ্পলকে তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে।
জিশান পাগলের মতো ওর মোটরবাইকের কাছে পৌঁছতে চাইছিল। ওর এখন মোটরবাইকটা দরকার। ওটাই এখন ওর সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে-উঠতে জিশান সুখারাম নস্করের কথা ভাবছিল। সুখারাম এখনও অকুস্থলে এসে পৌঁছতে পারল না কেন? ওর তো এতক্ষণ দেরি হওয়ার কথা নয়! তা হলে কি ও ট্র্যাকার দেখে জিশানের কাছাকাছি কোথাও এসে গেছে, কিন্তু পাহাড়ের ঢালে সঠিক জায়গাটা খুঁজে পায়নি?
আর বেশি ভাবার দরকার নেই! হাঁপাতে-হাঁপাতে জিশান ওর পুরোনো জায়গাটায় বেয়ে উঠল। ওই তো ওর রুকস্যাক! ওই তো ওর মোটরবাইক!
বিকেলের আলোয় জিশানকে ভারী অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। ওর মুখে, গালে, চিবুকে ঘাম আর রক্ত। হাত আর বুকের ওপরে আঁকা হয়ে গেছে রক্তের রেখা। সারা শরীরে জ্বালা-পোড়া। তিনটে ইস্পাতের পিন লম্বভাবে বিঁধে রয়েছে কপালে আর বাঁ-গালে। এতক্ষণ পিনগুলো খোলার কথা মনে হয়নি। এখন টান মেরে খুলে ফেলল। নতুন জ্বালার অনুভূতি হুল ফোটাল তিনটে বিন্দুতে। ভাগ্যিস এগুলোর ডগায় বিষ মেশানো নেই! আর হাতাহাতি লড়াইয়ের সময় প্রাোটনের নখের আঁচড় থেকে ও নিতান্ত ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে।
রুকস্যাক পিঠে নিয়ে মোটরবাইক ছুটিয়ে দিল জিশান। তার আগে বাইকের কেরিয়ারে রাখা প্লেট টিভিটা অন করে দিল। ছবি দেখা না যাক, অন্তত রানিং কমেন্ট্রিটা শোনা যাক। তা থেকে যতটুকু খবর পাওয়া যায়।
‘এইমাত্র আপনারা যা দেখলেন সেটা একটা অবিশ্বাস্য লড়াই। এইরকম থ্রিলিং টেবল-টপ ফাইট এর আগে কোনও কিল গেমে দেখা যায়নি। কিলার প্রাোটন এখনও অজ্ঞান হয়ে আছে। আশা করি আর কিছুক্ষণের মধ্যে ও জ্ঞান ফিরে পাবে। তারপর আবার নতুন এনার্জি নিয়ে লড়াইয়ে নামবে।
‘বন্ধুগণ, আপনাদের জানিয়ে রাখি কিল গেমের নানানরকম ইভেন্ট নিয়ে যেসব ”ফোরসি দ্য আউটকাম”-এর সুইপস্টেক-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে তাতে এ পর্যন্ত বাজি ধরেছেন চোদ্দোশো তিরিশ মিলিয়ন দর্শক। এরকম বিশাল নাম্বারের পার্টিসিপেশান আগে কখনও কোনও কিল গেমে দেখা যায়নি। দিস ইজ অ্যান অল টাইম রেকর্ড, ফোকস, অল টাইম সুপারডুপার হিট!
‘ওই দেখুন, জিশান এখন পাহাড় থেকে নামছে। কিন্তু রাস্তার শেষে রোড ব্লক রয়েছে। একটা গাড়ি সেখানে আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে গেছে কিলার প্রাোটন। দেখা যাক, আমাদের সুপারহিরো কী করে! আপনারা ভুলে যাবেন না, জিশান এখন উন্ডেড আর টায়ার্ড। সেটা ওকে দেখেই আপনারা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন।
‘আর-একটা প্লাস পয়েন্ট ফর জিশান। কিলার প্রাোটন এখন টেম্পোরারিলি ডি-অ্যাক্টিভেটেড হয়ে গেছে, কিন্তু তা সত্বেও জিশান ওর মোটরবাইকের কাছে এসে রুকস্যাক থেকে ওয়েপন নিয়ে আবার প্রাোটনের কাছে ফিরে যায়নি। ওকে পারমানেন্টলি ডিঅ্যাক্টিভেট করে দেয়নি। সো, ফোকস, থ্রি চিয়ার্স ফর জিশান, থ্রি চিয়ার্স ফর হিজ সফট হার্ট—।’
জিশান এসব শুনতে পাচ্ছিল আর পাকদণ্ডী বেয়ে নামছিল। একইসঙ্গে ভাবছিল, কী করে ও রোডব্লকটা পেরোবে। ওর সামনে পশ্চিমে ঝুঁকে পড়া সূর্য। সরাসরি যেন তাকিয়ে আছে জিশানের দিকে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ও পাহাড়ের প্রায় নীচের দিকে চলে এল। আর তখনই ওর চোখে পড়ল, সরু রাস্তায় প্রায় আড়াআড়িভাবে একটা রুপোলি রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার দুপাশে এমন কোনও ফাঁক নেই যা দিয়ে একটা মোটরবাইক গলে যেতে পারে।
জিশান বাইকের গতি কমাতে বাধ্য হল। এবং থামল। রুপোলি গাড়ির ‘পাঁচিল’টার দিকে তাকিয়ে রইল।
•
সুখারাম নস্করের ভালো লাগছিল না। ও জানে, ওর ফেরোসিটি কোশেন্ট 8.9। জানে, ও বেজির মতো ক্ষিপ্র, চন্দ্রবোড়ার মতো সতর্ক, তৎপর। আর ছুটতে পারে হরিণের মতো—সেটাও আবার একটানা, অনেকক্ষণ ধরে।
নিয়মিত শরীরচর্চা করাটা সেন্ট্রাল জেলের কয়েদিদের রুটিনের মধ্যে পড়ে। তা ছাড়া দৌড়ের অভ্যেসটা ও জেলের মধ্যেও বজায় রেখেছে। ফলে এখন ও বদনোয়ার গ্যাঙের তিন-চারজনের সঙ্গে খালি হাতে দিব্যি মহড়া নিতে পারে। তা সত্বেও শ্রীধর পাট্টা ওর সারা শরীরে নানান মারণাস্ত্র সাজিয়ে দিয়েছেন। আর বিশেষ যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য দিয়েছেন স্যাটেলাইট ফোন।