পাহাড়ের কালচে পাথরের মাঝে কালো পোশাক পরা প্রাোটনকে খুঁজে পাচ্ছিল না জিশান। তাই ও সামান্যতম নড়াচড়া দেখতে পাওয়ার অপেক্ষায় রইল।
কিন্তু হঠাৎই একটা অঘটন ঘটল।
পাহাড়ের পাথরের খাঁজে বোধহয় একটা চিল বাসা বেঁধেছিল। জিশান আচমকা ওটার সামনে হাজির হয়ে পড়তেই মা-চিলটা ডানা ঝপটে তেড়ে এল ওর দিকে। এবং সাপের ছোবল মারার ক্ষিপ্রতায় জিশানের কপালে বাঁকানো ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে দিল।
জিশানের কপাল কেটে রক্ত বেরিয়ে এল। শক্ত ঠোঁটের আঘাতে কপালে বেশ ব্যথাও টের পেল। কিন্তু তার চেয়েও মারাত্মক ক্ষতি হল অন্যভাবে।
জিশান ব্যালান্স হারিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে পড়তে লাগল।
পাহাড়ের ঢাল গড়িয়ে নেমে আসা শরীরটাকে প্রাোটন সহজেই দেখতে পেল। একটা পাথরের ওপরে দাঁড়িয়ে ও জিশানকে তাক করে লেসার টেলিশটার পরপর দুবার ফায়ার করল।
মুভিৎ টারগেট। তাই প্রাোটন লক্ষভ্রষ্ট হল। আশপাশের পাথরের ছিলকা উড়ে গেল। এবং জিশানের গড়িয়ে পড়া শরীর একেবারে প্রাোটনের ঘাড়ে এসে পড়ল।
দুটো শরীর জড়াজড়ি করে নীচে পড়ছিল, কিন্তু একটা পাথরের চাতাল ওদের বাঁচিয়ে দিল।
ওদের সংঘর্ষের জায়গা থেকে কয়েক মিটার নীচে একটা পাথরের চাতাল ছিল। তার শরীরে অনেক ছোট-বড় ফাটল, কিন্তু পাথরটা চেহারায় ঠিক যেন একটা বড় মাপের ডাইনিং টেবিল। তার গায়ের চারপাশে আর নানান ফাটলে শুধু আগাছা আর ঘাস।
জিশান আর প্রাোটন সেখানে এসে পড়ল। একটা শাখামুটি সাপ চাতালটায় শুয়ে বোধহয় রোদ পোহাচ্ছিল, চমকে উঠে সড়সড় করে একটা ফাটলে গিয়ে ঢুকে পড়ল।
নিজেকে সামলে নিতে জিশানের এক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগেনি। আর প্রাোটনের পেট লক্ষ্য করে লাথি চালাতে সময় লাগল বাড়তি আরও একটা সেকেন্ড।
প্রাোটনের লেসার টেলিশটার ওর হাত থেকে ছিটকে গিয়েছিল। পাহাড়ের ঢালের পাথরে-পাথরে ঠোক্কর খেয়ে ওটা নীচে পড়ে গেছে। রুকস্যাকের দশাও তাই। স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে কখন যেন আশপাশে ছিটকে পড়েছে।
আর জিশানের হালও একইরকম। ওর কোমরে গোঁজা মিসাইল গান চিলের আচমকা আক্রমণে নীচে পড়ার সময় কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। শুধু হান্টিং নাইফটা কোমরে তখনও ছিল। ওটার ফলার খোঁচা খেয়ে কোমরের বাঁ-দিকটায় কোথাও একটা চোট লেগেছে। জায়গাটা বেশ জ্বালা-জ্বালা করছে।
প্রাোটনের ক্ষিপ্র প্রতিবর্তী ক্রিয়া জিশানকে অবাক করে দিল। বেজির তৎপরতায় ও জিশানের লাথির সংঘাতটা প্রায় শতকরা নব্বই ভাগ এড়িয়ে গেল। সার্কাসের পেশাদার অ্যাক্রোব্যাটদের মতো দুবার সামারসল্ট খেয়ে পলকে চলে গেল জিশানের হাত-পায়ের নাগালের বাইরে।
এরপর যে-লড়াইটা হল সেটা কারাটে আর কিক বক্সিং-এর অদ্ভুত মিশেল। এই সব লড়াইয়ের আধুনিক নাম জিশান না জানলেও লড়াইটা জানে। আর প্রাোটনও তার চেয়ে কিছু কম জানে না।
ওদের দুজনের হাত-পা চলতে লাগল বিদ্যুৎগতিতে। আর সংঘর্ষের চোখাচোখা শব্দ হতে লাগল। ওর ছিপছিপে লম্বা প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখে জিশান তার শক্তি যতটা হওয়া উচিত বলে আঁচ করেছিল, এখন বুঝতে পারছিল প্রাোটনের শক্তি তার চেয়ে অনেকটা বেশি।
ঘুরন্ত চাকার মতো শরীরটাকে শূন্যে পাক খাইয়ে দিল প্রাোটন। একইসঙ্গে ওর ডান-পা একটা বৃত্তচাপ এঁকে দিল বাতাসে। আর পায়ের গতিপথে জিশানের চোয়ালকে পেয়ে গেল।
জিশান একটা ঝটকা দিয়ে মাথাটা সরিয়ে নিতে চেয়েছিল কিন্তু সেটার টাইমিং যে ঠিক হয়নি সেটা চোয়ালের আঘাত ওকে জানিয়ে দিল। ও পিছনদিকে টাল খেয়ে পড়ে গেল পাথরের দেওয়ালে। কিন্তু এক সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে আবার সামলে নিল।
প্রাোটন ওর পোশাকের কোনও একটা পকেট থেকে একটা ইস্পাতের স্টার বের করে নিয়েছিল। সেটার প্রান্তগুলো ক্ষুরের মতো ধারালো। স্টারটা মাপে একটা বিস্কুটের মতো। সেটা ডানহাতের তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে চেপে ধরল—যেন জিনিসটা একটা চ্যাপটা সিগারেট।
জিশান হান্টিং নাইফটা কোমর থেকে খামচে বের করে নিল। কিন্তু ততক্ষণে প্রাোটন পা ভাঁজ করে সামান্য কুঁজো হয়ে ইস্পাতের ঝকঝকে তারাটা ফ্রিসবি ছোড়ার ভঙ্গিতে জিশানের ডানহাত লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল।
ছোট্ট অস্ত্রটা বাতাস চিরে ধেয়ে গেল জিশানের দিকে, ওর ছুরি ধরা হাতের পিঠে গিয়ে প্রথম আঘাত করল, কিন্তু সেখানেই থামল না। দুরন্ত গতিতে চাকার মতো গড়িয়ে হাত বেয়ে ছুটে গেল। তারপর ছুঁচোবাজির মতো এলোমেলো বাঁক নিয়ে জিশানের বুকের ওপরে আড়াআড়িভাবে ধারালো ফলার দাগ টেনে দিল।
জিশানের হাত, বুক, জ্বলে গেল। রক্তের রেখা ফুটে উঠল হাতে, বুকে। হান্টিং নাইফ হাত থেকে খসে পড়ে গেল।
আচমকা আঘাত আর যন্ত্রণায় জিশান হয়তো কয়েক সেকেন্ডের জন্য কাবু হয়েছিল, সেই ফাঁকে প্রাোটন এক ঝাঁক ইস্পাতের পিন জিশানের চোখ-মুখ লক্ষ্য করে ছুড়ে দিয়েছে।
পিনগুলো মাপে ইঞ্চিচারেক। চকচকে। ডগাগুলো সূক্ষ্ম।
জিশান ঝটিতি বসে পড়েছিল। কিন্তু তা সত্বেও ও সবক’টা পিন এড়াতে পারল না। তিনটে ইস্পাতের পিন ছুটে এসে ওর কপালে আর গালে বিঁধে গেল।
সেই অবস্থাতেই জিশান একটা মাঝারি মাপের বোল্ডার তুলে নিয়ে শট পাটের ভঙ্গিতে ছুড়ে দিল। ওর শরীরটা চক্কর খেয়ে দেড়পাক ঘুরে গেল। এবং ভারি পাথরটা প্রচণ্ড ভরবেগ নিয়ে প্রাোটনের পেটে গিয়ে ধাক্কা মারল। সংঘর্ষের অভিঘাতে প্রাোটন পিছনদিকে টাল খেয়ে গেল। ব্যালান্স রাখার জন্য ও দু-হাত চরকির মতো শূন্যে ঘোরাতে লাগল। এই পড়ো-পড়ো অবস্থায় তিন-চার সেকেন্ড বাতাসে চিত-সাঁতার কাটল। তারপর টলে পড়ে গেল পাথরের চাতাল থেকে।