কিন্তু ওর ফটোটা ওরা পেল কোথায়?
তখনই জিশানের খেয়াল হল, এখন যে-জামাটা ও পরে রয়েছে, ফটোতে সেই জামারই ছবি। তার মানে, এই কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় কোনও লুকোনো ক্যামেরা ওর ফটো তুলে নিয়েছে।
জিশান মেয়েটিকে জিগ্যেস করল, ‘আমি কি এবার যেতে পারি?’
‘অফ কোর্স। অল দ্য বেস্ট, মিস্টার পালচৌধুরী…।’
অল দ্য বেস্ট।
তার মানে কী?
যে-মেয়েটি জানাচ্ছে, কিল গেম-এ সারভাইভ্যাল ফ্যাক্টর 0.07, সে-ই আবার বলছে, ‘অল দ্য বেস্ট।’ মেয়েটি কি জানে না, এই মরণখেলায় ‘অল দ্য বেস্ট’ হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা মাত্র সাত ভাগ!
নাকি এটাও স্ট্যাটুইটারি উইশ—ওই স্ট্যাটুইটারি ওয়ার্নিং-এর মতো?
জিশানের জিভ বিস্বাদ হয়ে গেল। একটা তেতো ভাব টের পেল ও। ওর রেজিস্ট্রেশান শেষ, স্মার্ট কার্ড পকেটে…অতএব এখন আর ফেরার কোনও পথ নেই।
শ্রীধর ইশারায় ওকে ডাকলেন।
চারজন গার্ড একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে। আর মাটিতে যে পড়ে ছিল সে পড়েই আছে।
জিশানকে নিয়ে বেরোনোর সময় শ্রীধর শকারটা ছুড়ে দিলেন পড়ে থাকা লোকটার গায়ে। এবং একইসঙ্গে ডানপায়ে সপাটে এক লাথি কষিয়ে দিলেন লোকটাকে। চাপা গলায় বললেন, ‘আরাম হারাম হ্যায়—।’
তারপর জিশানকে বললেন, ‘চলো, বাবু, তোমাকে জিপিসিতে পৌঁছে দিই। তারপর আমার ছুটি। তুমি প্যাকেটের বইপত্তরগুলো ভালো করে স্টাডি করে নিয়ো। কাল থেকে শুরু হবে অ্যাকশান। তুমি তৈরি থেকো, বাবু…।’
শ্রীধরের দিকে তাকিয়ে গলায় থুতুর দলা উঠে এল জিশানের। মনে হল, জঘন্য কাজ করার জন্য কিছু-কিছু জঘন্য লোকের জন্ম হয়।
•
জিমের নাম ‘ডিজিটাল’।
কেন যে এরকম নাম জিশান প্রথমে বুঝতে পারেনি। সেটা ওকে বুঝিয়ে দিল মনোহর।
মনোহর সিং জিপিসিতে জিশানের সাতদিন আগে এসেছে। তাই ও এখানকার খোঁজখবর জিশানের চেয়ে বেশি জানে।
‘ডিজিটাল’ নাম লেখা জিমনাশিয়াম বিল্ডিংটা প্রায় তিনতলা উঁচু। গোটা জিমটা ঠান্ডা—এয়ারকন্ডিশনড। এই জিমে ব্যায়াম-ট্যায়াম কিছু হয় না। শুধু হয় কমপিটিশান।
পার্টিসিপ্যান্টদের নিয়ে নানান রকমের কমপিটিশানের ব্যবস্থা আছে এখানে। কমপিটিশান না বলে সহজ কথায় লড়াই বলাই ভালো। আর সে-লড়াইয়ের উত্তর সবসময়েই ডিজিটাল—অর্থাৎ, বাইনারি ওয়ান আর জিরোর মতো—হয় জেতো, নয় হারো—মাঝামাঝি কিছু নেই। তবে এখানকার কর্মীরা এই লড়াইগুলোকে কখনও ‘ফাইট’ বলে না। বলে ‘কমপিটিশান’ বা ‘গেম’। এইসব গেম-এ প্রায়ই পার্টিসিপ্যান্টরা আহত হয়, বিকলাঙ্গ হয়, এমনকী মারাও যায়—কিন্তু তবুও এর নাম ‘গেম’।
জিমে ঢুকে চারদিকে তাকালে একেবারে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই নানান যন্ত্রপাতি। তার সঙ্গে আধুনিক কন্ট্রোল প্যানেল। প্যানেলে কম্পিউটার মনিটর, রঙিন পুশবাটন আর ইন্ডিকেটিং ল্যাম্প।
জিশান আর মনোহরকে নিয়ে মোট দশজন ঢুকেছে ডিজিটাল জিমে। ঢোকার সময় যে-যার পার্সোনাল স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করেছে। গেম শেষ হলে পর এখান থেকে নিজের পায়ে হেঁটে বেরোবে তিনজন। বাকি সাতজন বাতিল। কিল গেম-এর জন্য তাদের বলা হবে ‘আনফিট’।
মনোহরের কাছে ব্যাপারটা শোনার পর জিশানের মনে আশা জেগেছিল। মানে, প্রাথমিক পরীক্ষায় হেরে গেলে পর আসল পরীক্ষায়—অর্থাৎ, কিল গেম-এ—আর বসতে হবে না।
এ-কথা মনোহরকে বলতেই ওর কী হাসি! পেট চেপে ধরে হাসছে তো হাসছেই।
হাসি থামলে পর মনোহর বলল, ‘জিশান ভাইয়া, দুনিয়া এত সহজ নয়। তা হলে জিপিসিতে গেস্টহাউসে কিল গেম-এর আমরা যারা রয়েছি তারা সবাই একে-একে হেরে যাওয়ার চেষ্টা করবে আর সাতদিনেই খাঁচা খালি হয়ে যাবে। যখন কমপিটিশান চলে তখন সুপারগেমস কর্পোরেশনের কয়েকজন অবজার্ভার থাকে। ওরা গেমস কমিটিকে রিপোর্ট দেয়। যদি সেই রিপোর্টে কারও নামে এমন লেখা থাকে যে, সেই পাবলিক জেনুইন লড়েনি, তখন তাকে…।’ কথা থামিয়ে মনোহর আচমকা জিশানকে প্রশ্ন করল, ‘বলো দেখি, তাকে নিয়ে কী করে? বাতাও, কেয়া…?’
জিশান কিছু ভেবে উঠতে পারছিল না। ও ঠোঁট উলটে মাথা নাড়ল, বলল, ‘জানি না। কী করে তাকে নিয়ে?’
হাসল মনোহর, বলল, ‘তাকে ধরে হাংরি ডলফিন, ম্যানিম্যাল রেস—বা ওরকম কোনও ডেঞ্জারাস গেম-এ জোর করে নামিয়ে দেয়। ফারাক সিরফ দুটো ব্যাপারে : এই গেম-এ কোনও প্রাইজ মানি থাকে না, আর এই খেলার কোনও লাইভ টেলিকাস্ট হয় না। আভি সমঝে আপ?’
জিশান বুঝতে পারল—বেশ ভালো করেই বুঝতে পারল। ও মনোহরের ক্লেদহীন সরল মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
গোলগাল মুখ। ভুরু দুটো খুব ঘন। মাথায় কদমছাঁট চুল। নাকটা অতিরিক্ত ছড়ানো। আর সামনের দাঁতে কালচে ছোপ।
হাসলে মনোহরকে একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো দেখায়।
রেজিস্ট্রেশান কিটের ম্যানুয়াল আর বইপত্রগুলো এর মধ্যেই জিশান অনেকটা করে পড়ে ফেলেছে। সবরকমের পার্টিসিপ্যান্টের কথা মাথায় রেখে ম্যানুয়ালগুলো বাইলিঙ্গুয়াল—বাংলা আর ইংরেজিতে ছাপা। সেগুলো পড়ে অনেক নিয়মকানুনের কথা জেনেছে জিশান। তবে সেখানে মনোহরের কাছে শোনা এই বিচিত্র ‘শাস্তি’-র কথা লেখা নেই। তার কারণ, ম্যানুয়ালগুলো আগাপাস্তলা অফিশিয়াল এবং আইনমাফিক লেখা।
ডিজিটাল জিমে ঢুকে জিশান আর মনোহররা একপাশে লাইন করে দাঁড়িয়ে পড়ল।