করিডরের দেওয়ালগুলো ধপধপে সাদা, আর মেঝেতে চকচকে বাদামি গ্র্যানাইট পাথর। কোথাও এককণা ময়লা নেই, একবিন্দু অনিয়ম নেই।
চারপাশটা এত ঝকঝকে পরিষ্কার যে, জিশানের নোংরা জামা-প্যান্ট আরও নোংরা দেখাচ্ছিল। সঙ্কোচে জিশান একটু কুঁকড়ে গেল।
করিডরে ওরা এতবার বাঁক নিল যে, জিশানের দিক গুলিয়ে গেল।
একটু পরেই ওরা এসে দাঁড়াল একটা দরজার সামনে। দরজার মাথায় একটা লুমিনাস হেডিং জ্বলছে : রেজিস্ট্রেশান।
পকেট থেকে একটা ম্যাগনেটিক স্মার্ট কার্ড বের করলেন শ্রীধর পাট্টা। সেটা দরজার পাশের একটা স্লটে ঢুকিয়ে টানলেন। সঙ্গে-সঙ্গে কোথা থেকে যেন একটা রেকর্ডেড ভয়েস বলে উঠল : ‘থ্যাংকু য়ু।’ এবং দরজার পাল্লাটা স্লাইড করে সরে গেল একপাশে।
প্রহরীদের হাত নেড়ে চলে যেতে ইশারা করলেন শ্রীধর। ওরা অ্যাবাউট টার্ন করে করিডর ধরে হেঁটে রওনা হল।
জিশানকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীধর রেজিস্ট্রেশান রুমে ঢুকে পড়লেন।
বিশাল ঘর। ঘরের শেষ প্রান্তে গোটা দশ-বারো কাউন্টার। কাউন্টারের মাথায় জ্বলজ্বলে লাল আলোর হরফে নম্বর লেখা। প্রতিটি কাউন্টারে একটি করে ছিপছিপে মেয়ে বসে আছে। ওদের সামনে একটা করে কালো রঙের ল্যাপটপ কম্পিউটার।
কালো পোশাক পরা পাঁচজন সিকিওরিটি গার্ড ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের দুজনের চোখে অদ্ভুত ধরনের কালো চশমা। কোমরে চওড়া চামড়ার বেল্ট। বেল্টের একপাশ থেকে ঝুলছে গাঢ় নীল রঙের একটা রড, তবে তার হাতলের দিকটা কালো চামড়ায় মোড়া।
শ্রীধরকে দেখেই গার্ডগুলো টান-টান হয়ে দাঁড়াল। চোখ নামাল মেঝের দিকে।
শ্রীধর একজনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তীক্ষ্ণ চোখে তার পোশাকটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। ওপরওয়ালার জরিপ-নজরের সামনে গার্ডটা একেবারে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
গার্ডদের কালো পোশাকে সোনালি বিডের লাইনিং লাগানো। বুকে সোনালি ব্যাজ। ব্যাজের মনোগ্রামে সুন্দর ছাঁদে লেখা পি. এফ.।
গার্ডটির বুকের ব্যাজের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শ্রীধর পাট্টা। যেন চোখের তীব্র নজরে ব্যাজটাকে ভস্ম করে ফেলবেন। তারপর হাত বাড়িয়ে গার্ডের কোমর থেকে নীল রঙের রডটা তুলে নিলেন।
জিশান লক্ষ করল, রডটার কালো হাতলের কাছে একটা ছোট সুইচ রয়েছে।
সুইচটা অন করে চোখের পলকে রডের ডগাটা গার্ডটির পেটে চেপে ধরলেন শ্রীধর।
লোকটার শরীর স্প্রিং-এর মতো হেঁচকি তুলে ছিটকে লাফিয়ে উঠল। ওর মুখ দিয়ে অসহ্য যন্ত্রণার চিৎকার বেরিয়ে এল। চোখে লাগানো কালো চশমাটা ঠিকরে পড়ল দূরে।
শ্রীধর রডের ডগাটা ক্ষিপ্রভাবে আবার চেপে ধরলেন গার্ডের পাঁজরে।
থরথর করে কেঁপে উঠল লোকটা। তিনহাত পিছনে ছিটকে পড়ল। মেঝেতে পড়ে ছটফট করতে লাগল।
জিশানের দিকে তাকিয়ে হাসলেন শ্রীধর, বললেন, ‘খেয়াল করেছ, ওর বুকের ব্যাজটা একটু বেঁকাভাবে লাগানো রয়েছে? নিউ সিটিতে প্রতিটি মিসটেকের জন্যে হাই স্টেক। এমনিতে মস্তি, কিন্তু ভুল করলেই শাস্তি…।’
একটি গার্ডকে শাস্তি দেওয়ার কাজ যখন চলছিল, অন্য চারজন গার্ড তখন স্ট্যাচুর মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে। যেন ওদের চোখ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, ওদের কান কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।
নীল রডের মতো জিনিসটা তখনও শ্রীধরের হাতে শক্ত করে ধরা ছিল। তিনি সেটার সুইচ অফ করে দিলেন।
রডটার দিকে আঙুল দেখিয়ে আমতা-আমতা করে জিশান প্রশ্ন করল, ‘এটা কী?’
‘এটার নাম শকার।’ হেসে বললেন শ্রীধর পাট্টা, ‘শাসনের জন্যে দরকার। আর ওই কালো চশমাটা—ওই যে মেঝেতে পড়ে আছে…’ আঙুল তুলে চশমাটা দেখালেন শ্রীধর : ‘ওটা স্পেশাল এক্স-রে ভিশান স্পেক।’
জিশান তখনও রডটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। মাঝে-মাঝেই ওর দৃষ্টি ছিটকে যাচ্ছিল মেঝেতে পড়ে থাকা হতভাগ্য লোকটার দিকে। লোকটা এখনও অল্প-অল্প নড়ছে। কাতরাচ্ছে।
‘সুইচ অন করলে এটার মধ্যে ফোর হান্ড্রেড ভোল্টস এসি তৈরি হয়।’ শ্রীধর তখনও বলছিলেন, ‘তারপর কারও গায়ে চেপে ধরলে…ওই যে, নেংটি ইঁদুরটা মেঝেতে পড়ে চিঁ-চিঁ করছে…।’
রডটা সামনে ধরে পড়ে থাকা লোকটার দিকে দেখালেন শ্রীধর পাট্টা।
জিশান যেন একটা ধাক্কা খেল।
ইউনিফর্মের বুকে লাগানো ব্যাজটা সামান্য বেঁকে আছে বলে চারশো ভোল্টের শক! শ্রীধর কি মানুষ?
শকারটা বগলে চেপে ধরে শ্রীধর পকেট থেকে ছোট্ট শিশিটা বের করে নিলেন। শিশির মুখটা খুলে ওপরদিকে তাকিয়ে হাঁ করলেন। শিশি থেকে তিন ফোঁটা তরল মুখে ঢাললেন। জিভ টাকরায় ঠেকিয়ে চটপটি বাজির মতো ‘চটাস! চটাস!’ শব্দ করলেন কয়েকবার । জোরে-জোরে এপাশ-ওপাশ মাথা ঝাঁকালেন। ওঁর দু-গালে লাল আভা দেখা গেল। ওঁকে এখন অনেক চাঙ্গা মনে হল জিশানের।
এইবার জিশানকে ইশারায় কাছে ডেকে নিলেন শ্রীধর। সোজা এগিয়ে গেলেন সাতনম্বর কাউন্টারের কাছে।
কাউন্টারের মেয়েগুলো এতক্ষণ ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে শ্রীধরের কীর্তিকলাপ দেখছিল। এখন শ্রীধর আর জিশানকে কাছে এগিয়ে আসতে দেখে সাতনম্বর কাউন্টারের মেয়েটির মধ্যে প্রাণ এল।
‘কিল গেম পার্টিসিপ্যান্ট—’ ঠোঁট প্রায় ফাঁক না করেই কথাগুলো উচ্চারণ করলেন শ্রীধর।
‘কিল গেম’ কথাটা শোনামাত্রই কম্পিউটার কিবোর্ডে খটখাট শুরু করল মেয়েটি। তারপর জিশানের দিকে না তাকিয়েই যান্ত্রিক সুরে প্রশ্নমালা শুরু করল।