শ্রীধর পাট্টার ন্যাকা সুরের কথা শুনতে-শুনতে জিশানের গা-রিরি করছিল। পাশে বসে থাকা লোকটার উত্তাপ টের পাচ্ছিল ও। লোকটা যে একইসঙ্গে হিংস্র এবং জঘন্য সেটা জিশান ক্রমশ বুঝতে পারছিল।
গেম সিটির দিকে তাকাল জিশান।
কুড়ি কিলোমিটার বাই কুড়ি কিলোমিটার মানুষ মারার কল। যেন এক বিশাল খাঁচায় বেড়ালের ইঁদুর ধরার খেলা। জিশান ইঁদুর। আর অজানা তিনজন শিকারি—তারা হল বেড়াল।
মিনি আর শানুর কথা মনে পড়ল জিশানের। ওরা এখন বাড়িতে একা। জিশান নেই। মিনির নিশ্চয়ই ভীষণ ফাঁকা লাগছে।
জিশান তাকাল শ্রীধরের দিকে।
নির্বিকার মুখে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। চোয়ালের রেখা শক্ত। লাল টুকটুকে ঠোঁটে একবার জিভ বুলিয়ে নিলেন।
‘আমার ওয়াইফের সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে—।’ ঘষা গলায় আমতা-আমতা করে বলল জিশান।
শ্রীধর ওর দিকে তাকালেন। ঠোঁট ফাঁক না করে হাসলেন : ‘এর মধ্যেই উতলা? হায়, মা শীতলা! ধৈর্য—ধৈর্য। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে যাবে। স্পেশাল ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডের মাইক্রোভিডিয়োফোন পৌঁছে যাবে তোমার ওয়াইফ মিনির—তাই তো নামটা?—কাছে। তোমার কাছে থাকবে আইডেন্টিক্যাল আর-একটা হ্যান্ডসেট। তখন দশমিনিট ধরে যত প্রাণ চায় কথা বোলো—ফ্রি টকটাইম—কিল গেম পর্যন্ত। তারপর তো…’ মুখে ‘ফুস-স’ শব্দ করে আঙুল তুলে আকাশের দিকে দেখালেন শ্রীধর।
এই ইশারার অর্থ বুঝতে জিশানের অসুবিধে হল না। ও চুপ করে গেল। মাইক্রোভিডিয়োফোনটা হাতে পাওয়ার জন্য এখন থেকেই অপেক্ষা করতে শুরু করল।
মাথার ওপরে নীল আকাশ আর সোনালি রোদ। সূর্যের দিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। ধূমকেতু দুটোর রং এখন বোঝা যাচ্ছে না। সূর্যের আলোয় হারিয়ে গেছে। ঝকঝকে রোদে নীচের নিউ সিটিকে গ্রাফিক আর্ট বলে মনে হচ্ছে। তারই মাঝে ঝিকিয়ে উঠছে বেতার সংযোগের বল অ্যানটেনাগুলো।
শুটার তিনটে স্ক্রুর প্যাঁচের মতো অদ্ভুতভাবে পাক খেয়ে নেমে এল অনেকটা নীচে। সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টারটা দেখতে পেল জিশান।
বিশাল মাপের আকাশে-চুমু-খাওয়া বিল্ডিং। বিল্ডিংটার চারদিকেই রুপোর মতো ঝকঝকে পাত লাগানো। জানলা বলে কিছু চোখে পড়ছে না। বিল্ডিং-এর মাথার কাছটায় ধাতুর হরফে বড়-বড় করে লেখা :
The Syndicate HQ
আর লেখাটার নীচে সিন্ডিকেটের লোগো। লোগোটা গ্রাফিক ঢঙে আঁকা একটা ‘S’।
মিনিটখানেক যেতে-না-যেতেই শুটারগুলো শিস দিয়ে নেমে পড়ল সিন্ডিকেট বিল্ডিং-এর মসৃণ ছাদে।
শ্রীধর মোবাইল ফোন বের করে কার সঙ্গে যেন চাপা গলায় কথা বললেন। তারপর জিশানকে বললেন, ‘কাম অন, বয়। আমরা এসে গেছি—।
‘বয়’ সম্বোধনটা জিশানের ভালো লাগল না। ও বিরক্তভাবে শ্রীধরের দিকে তাকাল শুধু।
শ্রীধর ঠোঁট বেঁকিয়ে তেরছা হাসলেন। জিশানের থুতনিতে কড়ে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, ‘হরিদাসের দেখছি রাগ হয়েছে! এখনই এত রাগ করে না, সোনা। রাগ করার মতো এখনও প্রচুর ব্যাপার বাকি। রাগ করতে-করতে তুমি টায়ার্ড হয়ে যাবে। তখন তোমার সব রাগ ওয়াটার হয়ে যাবে—ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া।’
কথাটা শেষ করেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন শ্রীধর। শুটারের একটা অংশে বাঁ-হাতের ভর দিয়ে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় শূন্যে লাফ দিয়ে শুটারের বাইরে নেমে পড়লেন।
দাঁতে দাঁত চেপে রইল জিশান। ধীরে-ধীরে নেমে এল শুটার থেকে।
বাকি তিনজন প্রহরীও নেমে পড়েছিল অন্য দুটো শুটার থেকে।
সবাই নেমে পড়তেই শ্রীধর পাইলটদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন। সঙ্গে-সঙ্গে তিনটে শুটার শিস দিয়ে আবার ভেসে পড়ল আকাশে।
জিশান আগেই লক্ষ করেছিল, ছাদের মসৃণ মেঝেতে বড়-বড় মাপের খোপ কাটা—অনেকটা দাবার ছকের মতো। গোটা ছাদটা ছাই রঙের হলেও তার মধ্যে একটা খোপের রং কুচকুচে কালো।
সবাইকে ডেকে নিয়ে সেই খোপটার ওপরে গিয়ে দাঁড়ালেন শ্রীধর। পা দিয়ে মেঝেতে তিন-চারবার শব্দ করলেন। অমনি সেই কালো অংশটা নামতে শুরু করল নীচের দিকে।
জিশান একপলকের জন্য চমকে উঠেছিল।
সেটা লক্ষ করে শ্রীধর মুচকি হেসে বললেন, ‘অটোমেটিক প্লেট এলিভেটর—অডিয়ো অ্যাকটিভেটেড।’
জিশান অবাক হয়ে ভাবছিল, ষোলো বছরে নিউ সিটিতে প্রযুক্তি অনেকটাই এগিয়ে গেছে। আর ওল্ড সিটিতে সেটা দ্বিগুণ গতিতে পিছিয়ে গেছে।
এলিভেটর মসৃণভাবে নীচে নামছিল। এলিভেটর শ্যাফটের চার দেওয়াল থেকে হালকা নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছিল জিশানদের ওপরে। একটা দেওয়ালে বসানো অনেকগুলো আলোর বোতাম। এলিভেটরের সঙ্গে-সঙ্গে বোতামগুলোও সমান গতিতে নেমে চলেছে—অনেকটা উৎসবের আলোকসজ্জার চলমান টুনি বাতির মতো।
বোতামগুলোর ওপরে সংখ্যা লেখা রয়েছে।
শ্রীধর ‘23’ লেখা বোতামটি টিপলেন। তারপর যেন আপনমনেই বললেন, ‘টোয়েন্টি থার্ড ফ্লোরে রেজিস্ট্রেশান ডেসক। আমরা সেখান থেকে শুরু করব।’
•
সিন্ডিকেট বিল্ডিং-এর সবকিছুই জিশানকে অবাক করছিল। মনে হচ্ছিল, ও বিশাল কোনও মহাকাশযানের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
চারপাশে ঠান্ডা নরম আলো। ভাবলেশহীন মুখ নিয়ে ইউনিফর্ম পরা কর্মীরা যাতায়াত করছে। কারও মুখে কোনও কথা নেই—শুধু মসৃণ মেঝেতে জুতোর খটখট শব্দ। এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
গোটা বাড়িটাই যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেটা জিশান শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিল। এখন করিডর দিয়ে হাঁটার সময় ওর বেশ শীত-শীত করতে লাগল।