মালিকের কথা মনে পড়ল জিশানের : ‘…কার্তিক সালাকে না উড়িয়ে তুই জল খাবি না। গড প্রমিস।’
সুপারগেমস কর্পোরেশনকে কি কার্তিক বলে ভাবা যায়? যদি যায়, তা হলে ওর ঊরুসন্ধিটা কোথায়? জিশান জানে, ‘কিল গেম’ খেলার নিয়ম হচ্ছে, ওই খেলায় কোনও নিয়ম নেই। বাঁচার জন্য তুমি যা খুশি করতে পারো।
ও চোয়াল শক্ত করে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। ষোলো বছর পর ও আবার নিউ সিটিতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। যদি খেলায় ও হেরে যায় তা হলে নিউ সিটিতে আর থাকতে পারবে না। ফিরতে পারবে না ওল্ড সিটিতেও।
ওকে চলে যেতে হবে ওপরে।
পাশে বসা শ্রীধর মুখ ফিরিয়ে তাকালেন জিশানের দিকে, হেসে জিগ্যেস করলেন, ‘কী বাবু, চুপচাপ কেন? ভয় করছে?’
জিশান সরাসরি তাকাল শ্রীধরের দিকে। ঠান্ডা পাথরের মতো গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, ভয় করছে—তোমার জন্যে।’
অন্ধকার আকাশ চিরে তিনটে শুটার শিস দিয়ে উড়ে চলল।
জিশানের হঠাৎই মনে হল, ওরা শিস দিয়ে গান গাইছে। মৃত্যুর গান।
•
রাতটা জিশানের কাটল ওল্ড সিটিতেই—পিস ফোর্সের হেড-অফিসের গেস্টহাউসে।
শ্রীধর পাট্টা নিউ সিটিতে যেতে চাইলেও যাওয়া হয়নি।
শুটারের পাইলটকে সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টারে উড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন শ্রীধর। কিন্তু পাইলট হঠাৎই সমস্যার কথা জানিয়েছে। একটি শুটারের ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়ায় একটা টার্বোপ্রপ কাজ করছে না।
তখন শ্রীধর যে-ভাষায় পাইলটকে গালিগালাজ করলেন সেটা বোধহয় শুধু ওঁকেই মানায়। তারপর মোবাইল ফোন বের করলেন পকেট থেকে, চটপট হেডকোয়ার্টারে যোগাযোগ করলেন।
সাংকেতিক ভাষায় কথাবার্তা চলল কিছুক্ষণ। জিশান তার একবর্ণও বুঝতে পারল না।
অবশেষে ফোন ছেড়ে দিয়ে শ্রীধর তাকালেন জিশানের দিকে, হাসলেন: ‘জিশান, আজকের রাতটা আমাদের পিস ফোর্সের এখানকার গেস্টহাউসে থাকতে হচ্ছে। সেখানেই হবে তোমার রেস্ট। সেটাই বোধহয় বেস্ট। আর কাল থেকে শুরু হবে তোমার টেস্ট।’
টেস্ট! কীসের টেস্ট?
জিশান শুনেছে কিল গেম-এ নামার আগে বড় মাপের ট্রেনিং আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু সেগুলো ঠিক কী ধরনের পরীক্ষা জিশান জানে না।
শ্রীধরের অন্ত্যমিল মন্তব্যগুলোর কোনও জবাব দিল না ও।
ততক্ষণে শুটারের নাক ঘুরিয়ে ওরা রওনা হয়ে গেছে ওল্ড সিটির পিস ফোর্সের হেডকোয়ার্টারের দিকে।
হেডকোয়ার্টারে নেমে সোজা গেস্টহাউসের ঘর।
এরকম আরাম জিশান শেষ কবে পেয়েছে মনে পড়ে না।
শোওয়ার জন্য গোটা একটা ঘর—তাও আবার মাপে বিশাল। চারপাশে ধপধপে সাদা দেওয়াল। রাজহাঁসের পালকের মতো বিছানা। শীতাতপের আরাম চারপাশে ভাসছে। খুব নিচু সুরে মনভোলানো বাঁশি বেজে চলেছে। বাতাসে একটা পাগল করা সুবাস।
সব মিলিয়ে মোলায়েম আরামে চোখ বুজে আসছিল জিশানের।
ওর চোখে-মুখে হতবাক ভাব দেখে শ্রীধর বলে উঠলেন, ‘সিন্ডিকেটের গেম পার্টিসিপ্যান্টস ক্যাম্পাসের গেস্টহাউসে তোমার জন্যে থাকার ব্যবস্থা অনেকটা এইরকম। তবে এর চেয়েও ভালো।’
এর চেয়েও ভালো হওয়া সম্ভব! অবাক হয়ে ভাবল জিশান।
রাতে বিছানায় গা ঢেলে দিয়ে স্বপ্নের দেশে তলিয়ে গেল ও। বুঝতে পারল, এইসব বিছানায় স্বপ্ন অনেক সহজে আসে।
স্বপ্নে মিনি আর শানুকে দেখতে পেল। সেই স্বপ্ন ভাঙল ভোরবেলায়—ঘুম ভাঙার সঙ্গে-সঙ্গে।
জিশান দেখল, শ্রীধর পাট্টা ওঁর টিপটপ পোশাক পরে জিশানের বিছানার সামনে হাজির। সঙ্গে কাঠখোদাই তিন প্রহরী।
ওকে নিয়ে ভোরের আকাশে ভেসে পড়ল তিনটে শুটার।
জিশান অবাক চোখে দূরের নিউ সিটির দিকে তাকিয়ে রইল। কতদিন পরে শহরটাকে ও দেখতে পাবে!
নিউ সিটিকে কখনও পাখির চোখে দেখেনি জিশান। শুটার থেকে এই প্রথম দেখল।
উঁচু-উঁচু আকাশছোঁয়া মিনার, আর তার ফাঁকে-ফাঁকে আয়তাকার সবুজ কিংবা নীল।
সবুজগুলো পার্ক, কিংবা চাষের খেত। অথবা পরিকল্পনা করে তৈরি করা বনাঞ্চল। নিউ সিটিতে অবহেলায় পড়ে থাকা কোনও সবুজ মাঠ নেই। সব সবুজকেই এখানে কাজে লাগানো হয়েছে।
আর নীলগুলো জল। কোনওটা সুইমিং পুল, কোনওটা আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের দিঘি।
মাঝে-মাঝে হালকা নীল যে-চৌকোনা রং দেখা যাচ্ছিল সেগুলো খেলার মাঠ। মাঠে সিনথেটিক টার্ফ লাগানো। এইসব মাঠে ছেলেবেলায় খেলেছে জিশান।
এ-কথা মনে পড়তেই ও ছেলেবেলায় ঢুকে পড়ল পলকে।
ফিটফাট হয়ে জিশান স্কুলে যাচ্ছে। এয়ারকন্ডিশনড স্কুল বাস। বাস চলার কোনও শব্দ নেই। ধোঁয়ার দূষণ নেই—কারণ, বাসগুলো সব ব্যাটারি পাওয়ারড ভেহিকল। ছবির মতো পথ ধরে জিশানদের বাস স্কুলের দিকে ছুটে চলেছে।
অ্যাস্ট্রো টার্ফের ওপরে খেলছে জিশান। বন্ধুদের নাম ধরে চিৎকার করছে। রবিন, টুকাই, নোনা, বুকি। ওরা সব এখন কোথায় কে জানে! জিশানের মতো ওল্ড সিটিতে নিশ্চয়ই চলে যায়নি—কিংবা যেতে বাধ্য হয়নি।
না:, ছেলেবেলাটা খারাপ ছিল না। এই ছেলেবেলার গল্প মিনিকে কতবার শুনিয়েছে জিশান। আক্ষেপ করে বলেছে, শানুর ছেলেবেলাটা এরকম সুন্দর করতে পারলে কত ভালো হত।
হঠাৎই আঙুল তুলে নীচের দিকে দেখালেন শ্রীধর পাট্টা। বললেন, ‘ওই যে, জিশানবাবু। ওটাই গেম সিটি। ওখানেই তুমি খেলবে কিটি-কিটি। বেড়াল আর নেংটি। হাইড অ্যান্ড সিক…হাইড অ্যান্ড সিক। পুরো চব্বিশ ঘণ্টা। তোমার লুকোচুরি খেলার লাইভ টেলিকাস্ট হবে…পাবলিক দেখবে। কী থ্রিলিং হবে মাইরি!’