জিশান লাফিয়ে পড়ল শ্রীধরের বাঁ-হাতের ওপরে। হাতটা আঁকড়ে ধরে প্রাণপণে ছাড়াতে চাইল। কিন্তু পারল না।
তার কারণ, জিশান হাতটা ধরে টানাটানি শুরু করতেই শ্রীধর ওঁর ডানহাতে ধরা পিস্তলটা প্রচণ্ড জোরে জিশানের কাঁধে বসিয়ে দিয়েছেন। আর জিশান সঙ্গে-সঙ্গে কাঁধ চেপে ধরে বসে পড়েছে মেঝেতে।
এক ধাক্কায় মিনিকে ছিটকে ফেলে দিলেন শ্রীধর। মেয়েটা ঘরের কোণে রাখা একটা ঝুড়ির ওপরে গিয়ে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে শ্রীধর সঙ্গীদের ইশারা করলেন। ওরা তিনজন জিশানকে ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে চেপে ধরল। তারপর টানতে-টানতে নিয়ে চলল ঘরের বাইরে।
চলে যাওয়ার আগে শ্রীধর মিনিকে লক্ষ করে বললেন, ‘চলি, শ্রীমতী পালচৌধুরী। ভয় নেই…আপনার সঙ্গে আমাদের রেগুলার যোগাযোগ থাকবে। আমরা আপনাকে একটা ভিডিয়ো-মোবাইল সেট দিয়ে যাব। সেটা আমাদের স্পেশাল ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডে কাজ করে। ওটা দিয়ে আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে কনস্ট্যান্ট কানেকশান রাখতে পারবেন।’
মিনি তখন ঘরের কোণে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে আছে শ্রীধরের দিকে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে না, ওঁর কথার একটি বর্ণও মিনির মাথায় ঢুকেছে।
প্রহরী তিনজন চৌকাঠের বাইরে এসে শ্রীধর পাট্টার জন্য দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কয়েক লহমা অপেক্ষা করছিল। তখন জিশান ঘুরে তাকাল ঘরের দিকে। দেওয়ালে টাঙানো বাবার ফটোর ওপরে চোখ পড়ল ওর।
বাবা তাকিয়ে আছে জিশানের দিকে। স্থির শান্ত চোখে এক অলৌকিক আত্মবিশ্বাস।
জিশান শ্বাস টানল, মিনির নাম ধরে ডাকল দুবার।
শ্রীধর পাট্টা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। মিনিও ওঁর পিছন-পিছন ছুটে বেরিয়ে এল বাইরে।
মিনির দিকে না তাকিয়েই শ্রীধর মসৃণ নরম গলায় তখনও ওকে বলে চলেছেন, ‘টাকা-পয়সার জন্যে চিন্তা করবেন না, মা-মণি। অন্ন চিন্তাও করবেন না। ওসব ব্যবস্থা আমরা করব—যদি অবশ্য ”কিল গেম”-এ নাম দেয় আপনার হাজব্যান্ড। আন্ডারস্ট্যান্ড? আর যদি শ্রীপালচৌধুরী খেলায় জিতে যান, তা হলে একশো কোটি টাকা আপনাদের। তখন এই নোংরা জঘন্য মস্তিহীন বস্তিতে আপনাদের আর থাকতে হবে না। সুতরাং আপনাদের জন্যে ব্রাইট ফিউচার ওয়েট করছে। যদিও তাতে স্লাইট রিসক আছে।’
ওঁরা বস্তির গলিপথ ধরে হেঁটে রওনা দিলেন।
মলিন আলো-আঁধারি গলিতে দুপাশে ছায়া-ছায়া মুখ দেখতে পাচ্ছিল জিশান। পাড়াপড়শিদের কৌতূহলী ভিড়।
ছ’জনের মিছিলটা ধীরে-ধীরে বেরিয়ে এল গলির বাইরে। পিছনে উৎসাহী জনতার দল।
প্যাঁচর ডাক শুনতে পেল জিশান। শুনতে পেল মিনিও। ভয়ে ওর বুকটা দুরুদুরু করে উঠল।
কিন্তু জিশান প্যাঁচার ডাকটাকে পাত্তা দিল না। বরং ভাবল, যদি এই ডাকটা অশুভ হয়, তা হলে সেটা শ্রীধরের জন্যও হতে পারে।
গলি থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে অনেকটা ঘুরে আর-একটা রাস্তায় এল ওরা। রাস্তার একপাশে আবর্জনার স্তূপ। সেখানে নেড়ি কুকুরের ভিড়।
তারই আড়ালে দাঁড়িয়েছিল তিনটে শুটার। নীল-সাদা ডোরাকাটা লম্বাটে চেহারা। হুড খোলা। সামনে লাগানো টার্বো-প্রপ।
ওরা সবাই শুটারের দিকে এগোল। খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে পাড়াপড়শির ঝাঁকও সঙ্গে-সঙ্গে এগোল।
মিনি জিশানের হাত আঁকড়ে ধরল। কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘আমি আর শানু সবসময় তোমার কথা ভাবব।’
‘আমিও তোমাদের কথা ভাবব। এ ছাড়া এই জীবনে ভাবার মতো আর কী আছে! তুমি বাড়ি যাও…শানু একা রয়েছে…।’ কথা শেষ করতে গিয়ে জিশানের গলা ভেঙেচুরে গেল। ওর ভেতরটাও।
মিনি ঠোঁট টিপে কান্না আটকাতে চাইল। মাথা নাড়তে লাগল বারবার। যেন বলতে চাইল : ‘যেয়ো না! তুমি যেয়ো না…।’
জিশান ভেতরের কষ্ট আর সইতে পারছিল না। এভাবেই তা হলে ‘কিল গেম’-এর খেলোয়াড় জোটায় সুপারগেমস কর্পোরেশন! দু-মাস কি আড়াইমাস আগে ‘কিল গেম’-এর যে-লাইভ টেলিকাস্ট হয়েছিল তাতে ছেলেটা ষোলো ঘণ্টার পর মারা গিয়েছিল। ওর ফ্যামিলি বলতে কিছু ছিল কি না জিশান জানে না।
কিন্তু জিশানের?
জিশান শুধু ফ্যামিলি নয়, ওর প্রাণটাও রেখে যাচ্ছে এই বস্তিতে। আর ওর দেহটা যাচ্ছে ‘কিল গেম’-এ লড়তে। যদি প্রাণ ফিরে পাওয়ার জন্য ওর দেহটাকে ওই মরণখেলায় লড়তেই হয়, জিশান দেখিয়ে দেবে লড়াই কাকে বলে। চব্বিশ ঘণ্টা নয়, পুরোপুরি তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিটই ও লড়বে। দরকার হলে তেইশ ঘণ্টা ঊনষাট মিনিট ষাট সেকেন্ড। শিকার আর শিকারির খেলায় ও হাড়ে-হাড়ে বুঝিয়ে দেবে কে শিকার, আর কে শিকারি।
জিশানের নজর ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। চোখ মুছে নিয়ে ও তাকাল মিনির দিকে। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তুমি বাড়ি যাও—শানু একা রয়েছে—ভয় পাবে।’
জিশানকে ধাক্কা মেরে শুটারে তুলল মার্শালের দলবল।
তারপর তীব্র সিটি দিয়ে তিনটে শুটার ছুটতে শুরু করল। কয়েকটা বাড়ির ময়লা জানলার কাচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। একটু পরেই শুটারগুলো ভেসে উঠল শূন্যে। মিনি আর জটলা করা মানুষজন ছোট হয়ে দূরে মিলিয়ে যেতে লাগল। একইসঙ্গে ওল্ড সিটিও।
আকাশে চোখ রাখল জিশান। কোথাও-কোথাও ছন্নছাড়া মেঘ থাকলেও চাঁদ এবং রঙিন ধূমকেতু দুটো চোখে পড়ছে। আরও নীচে…দূরে…বহু দূরে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য রঙিন আলোর বিন্দু…নেকলেসের মতো চিকচিক করছে। রাতের নিউ সিটি—যেখানে জিশান এখন যাচ্ছে।