খেলায় নামার আগে খেলোয়াড়কে বন্ড সই করতে হয়—যেমন করতে হয় অপারেশানের আগে। সেই বন্ডে লেখা থাকে : ‘ ”কিল গেম”-এ মৃত্যু হলে কিংবা অঙ্গহানি হলে সুপারগেমস কর্পোরেশন দায়ী নয়।’
এ ছাড়া খেলোয়াড়কে এক কোটি টাকার ইনশিয়োরেন্স করিয়ে দেয় নিউলাইফ ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি। খেলায় ক্যান্ডিডেটের ভালো-মন্দ কিছু হলে তার ফ্যামিলি ওই এক কোটি টাকা পায়।
‘কিল গেম’ খেলাটা হয় নিউ সিটির একটা নকল শহর ‘গেম সিটি’-তে। শহরটার মাপ কুড়ি কিলোমিটার বাই কুড়ি কিলোমিটার। সেই শহরে রাত বলে কিছু নেই—সবসময়েই পড়ন্ত বিকেলের আলো চারশো বর্গকিলোমিটারের গেম সিটি-তে ছড়িয়ে আছে। সেই অদ্ভুত গোধূলি আলোয় গেম সিটি জেগে ওঠে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য।
কী নেই সেই গেম সিটি-তে! পাহাড় আছে, ঝরনা আছে, জঙ্গল আছে, নকল নদী আছে, আছে বাড়ি-ঘর, যানবাহন, দোকানপাট। একটা আধুনিক শহরে যা-যা থাকে তার সবই আছে। শুধু নেই কোনও মানুষ।
‘কিল গেম’-এ কোনও খেলোয়াড় ‘স্বেচ্ছায়’ নাম দিলে তখন চব্বিশ ঘণ্টার জন্য শহরটা লোকজনে টগবগ করে। যেমন, জিশান এখন ‘স্বেচ্ছায়’ নাম দিতে বাধ্য হচ্ছে।
‘কিল গেম’ খেলাটার লম্বা প্রাোমো টিভিতে বহুবার দেখেছে জিশান। প্রায় একঘণ্টা ধরে দেখানো হয় সেই প্রাোমো।
যেদিন চব্বিশ ঘণ্টার খেলাটা শুরু হয় তার আগের দিন থেকেই গেম সিটি-কে সাজিয়ে ফেলা হয়। বাড়ি-ঘরগুলো ‘বেড়াতে আসা’ টুরিস্ট ফ্যামিলিতে ভরে যায়। দোকানপাট ভরে যায় লোভনীয় খাবারদাবারে। সেসব দোকানে তদারকি করে একদিনের নকল দোকানদাররা। আর রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায় নানান গাড়ি। বহু গাড়ি এখানে-সেখানে দাঁড় করানো থাকে—যেন মনে হয়, গাড়িগুলো পার্ক করে মালিক বা ড্রাইভাররা এদিক-ওদিক কোথাও গেছে।
সব মিলিয়ে যে-ছবিটা তৈরি হয় সেটা আসল কোনও শহরের মতোই। তবে সমুদ্র নেই এই যা!
‘কিল গেম’ খেলার সময় গেম সিটি-তে যারাই থাকে তারা সবাই ‘টুরিস্ট’ হলেও ‘কিল গেম’-এর পার্টিসিপ্যান্ট। খেলার আগের দিন তারা সবাই এসে খালি হাতে গেম সিটি-তে ঢুকে পড়লেই হল। বাকি সব ব্যবস্থার দায়িত্ব সুপারগেমস কর্পোরেশনের। ফলে পার্টিসিপ্যান্টদের জন্য সব ফ্রি। যেমন খাবারের দোকানে খেতে গেলে পয়সা লাগবে না, তেমনই গাড়ি চড়ে ঘোরা যাবে বিনাপয়সায়। অর্থাৎ, থাকা-খাওয়া-বেড়ানোর কোনও খরচ নেই।
অথচ পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ আছে।
আর সবচেয়ে বড় পুরস্কার রয়েছে চারজনের জন্য।
তার মধ্যে আবার সেরা পুরস্কারের দাবিদার হবে জিশান। বাকি তিনজন পাবে সমান অঙ্কের দ্বিতীয় পুরস্কার।
কিন্ত খেলাটা কী?
খুবই সহজ-সরল। খেলার দিন খেলার হিরোকে ভোর ছ’টায় ঢুকিয়ে দেওয়া হবে গেম সিটি-তে। আর তার দু-ঘণ্টা পর হিরোকে ‘শিকার’ করতে তিনজন কিলার বেরিয়ে পড়বে। তারপর চলবে শিকার-শিকারি খেলা। বাইশ ঘণ্টা ধরে হিংস্র লুকোচুরি। যদি নায়ক খেলার শেষে বেঁচে থাকে, তবেই পাবে একশো কোটি টাকা। আর যদি…।
না:, আর ভাবতে চাইল না জিশান। ও ব্যথাতুর চোখে মিনির দিকে তাকাল। মিনির চোখে নজর পড়তেই জিশানের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। এত মায়া ওই রোগা মেয়েটার দু-চোখে! শেষ দেখার সময় লোকে বোধহয় এভাবেই তাকায়।
শ্রীধর পাট্টা ছোট্ট করে হাততালির শব্দ করলেন, গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘বলো, বাবু, কী করবে? ধারা তিনশো দুই—না কিল গেম? অবশ্য অল দ্য সেম—শুধু ”কিল গেম”-এ বাঁচার সামথিং সম্ভাবনা আছে এই যা।’
জিশান উঠে বসল মেঝে থেকে। ওর মাথা ঝিমঝিম করছিল। সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল।
ও সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছে তো? শুনতে পাচ্ছে তো ঠিকঠাক?
ওই তো মিনি! ওর পাতলা ঠোঁট কাঁপছে। চোখের কোলে জলের ফোঁটা।
জিশান এবার উঠে দাঁড়াল। কালো পোশাক পরা তিন প্রহরীর দিকে একবার তাকাল। ওরা পিস্তল নাড়িয়ে জিশানকে সতর্ক করে দিল।
জিশান সেসব ভ্রূক্ষেপ না করে শ্রীধর পাট্টার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। শান্ত গলায় জিগ্যেস করল, ‘এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই?’
‘না গো, নেই। এই খেলাটায় কী আর মেলা পাবলিক পাওয়া যায়! কোটিতে গুটি-গুটি। তাই তিনশো দুই, নয় তো ”কিল গেম”।’
‘কখন যেতে হবে আমাকে?’
‘আমরা তোমাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে এসেছি, জিশান। এখান থেকে শুটারে চড়ে আমরা সোজা চলে যাব সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টারে। সেখানে কতকগুলো ফরমালিটি সেরে তারপর সোজা সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেমস বিল্ডিং। তারপর…।’
‘তারপর?’ প্রশ্নটা করে মনে-মনে নিজের ভবিষ্যতের ছবিটা আঁকতে চেষ্টা করল জিশান।
হাসলেন শ্রীধর। পিস্তলটা নাচাতে-নাচাতে বললেন, ‘তারপর শুরু হবে প্রিলিমিনারি গেমস। এই গেমগুলো বলতে গেলে ”কিল গেম”-এর ট্রেনিং। এই ট্রেনিং চলবে দু-মাস। তারপর স্পেশাল ট্রেনিং। এই ট্রেনিং-এর পর তুমি রেডি হলে গেমের ডেট অ্যানাউন্স করা হবে। প্লেট টিভিতে খবর পৌঁছে যাবে সব জায়গায়—ওল্ড সিটিতে, নিউ সিটিতে…।’
মিনি আর থাকতে পারল না। হিংস্রভাবে চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্রীধরের ওপরে।
শ্রীধর পলকে বাঁ-হাতটা বাড়িয়ে লোহার আঙুলে মিনির টুঁটি টিপে ধরলেন।
‘আঁক’ শব্দ করে মিনির চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল মাঝপথে। ওর চোখ দুটো কোটর ছেড়ে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল। ও হাঁ করে এক আঁজলা বাতাস টানার জন্য আইঢাই করতে লাগল।