‘মিথ্যে কথা! আমি জুয়া খেলিনি!’
‘তাই?’ কপট বিস্ময়ে চোখ বড়-বড় করলেন শ্রীধর পাট্টা, ন্যাকা ঢঙে বললেন, ‘আমার নক্ষী ছোনা চাঁদের কণা! আমার ছোনা কি-চ্ছু করেনি! ন-এ ন্যাকা, আর ব-এ বোকা! শুনুন—’ শ্রীধরের কথা বলার ঢং হঠাৎই বদলে গেল। রঙ্গপ্রিয় মেয়েলি ভাব উধাও হয়ে তিনি পুরোপুরি মার্শাল হয়ে গেলেন: ‘শুনুন, পালচৌধুরী! আমাদের কাছে অনেক উইটনেস আছে। স্যাটেলাইট ডেটাও আছে। সেইসঙ্গে ডিজিটাল ফটোগ্রাফ। জুয়া আপনি খেলেছেন আর খুনও করেছেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ, হান্ড্রেড পার্সেন্ট। আমাদের সিন্ডিকেটকে নিগেট করে কখনও কিছু করা যায় না। আমাদের লক্ষ-লক্ষ চোখ।’
জিশান অবাক হয়ে ভাবছিল।
খালধারের ওই ফাইট গেম ইল্লিগ্যাল! তা হলে সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেমগুলো? সেগুলো সব লিগ্যাল!
‘স্নেকস অ্যান্ড জেমস’, ‘মাই লাইফ উইথ আ টাইগার’, ‘ম্যানিম্যাল রেস’, কিংবা ‘হাংরি ডলফিন’ গেম-এ কেউ যদি মারা যায় তা হলে সেটা উইলফুল মার্ডার নয়?
আর ‘কিল গেম’? সেই খেলায় তো আজ পর্যন্ত বহু মানুষই মারা গেছে—ওল্ড সিটির সব মানুষ। তার বেলা?
মালিকের কথা মনে পড়ল জিশানের। কুচকুচে কালো, ঝকঝকে দাঁত, দিলখোলা হাসি, মিষ্টি মুখ।
ওর মৃত্যুটা তা হলে কী? ওটা উইলফুল মার্ডার নয়?
মিনির কান্নায় ঘোর কাটল জিশানের। মিনি হাতের পিঠ কামড়ে গুঙিয়ে কাঁদছে।
এখন তা হলে কী হবে? দিশেহারা পাগল হয়ে গেল জিশান। ওর ভেতরে একটা জংলি চিতা খেপে উঠল।
তখন শ্রীধর পাট্টা ধীরে-ধীরে বলছেন, ‘এবার তা হলে আমরা পানিশমেন্টের কথায় আসি, মিস্টার পালচৌধুরী—।’
জিশান পাগলের মতো একলাফে ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্রীধরের ওপরে এবং শ্রীধর কাত হয়ে টুল থেকে পড়ে যেতে-যেতে গুলি চালালেন।
প্রচণ্ড শব্দে ছোট্ট ঘর থরথর করে কেঁপে উঠল। গুলিটা গিয়ে লাগল দেওয়ালে ঝোলানো একটা বাঁধানো ছবিতে। ভাঙা কাচের টুকরো ফুলঝুরির মতো চারিদিকে ছিটকে গেল।
জিশান ভয় পেয়ে শ্রীধরকে ছেড়ে একপাশে লাফিয়ে পড়ল।
তিনজন গানম্যান পলকে পিস্তল উঁচিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা জিশানকে টিপ করে ফ্রিজ শট হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। শ্রীধর না বললে ওদের গুলি চালানোর হুকুম নেই।
শ্রীধর পাট্টা মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ডানহাতের পিস্তলটা জিশানের দিকে তাক করে হাসলেন : ‘আপনি কি বাবু বুঝতে পেরেছেন যে, গুলিটা আমার মিস হয়নি—ইচ্ছে করে মিসফায়ার করেছি?’ বাঁ-হাতে পোশাক ঝাড়তে লাগলেন শ্রীধর। তারপর ধীরে-ধীরে চুইংগাম চিবোনোর ঢঙে বললেন, ‘তার কারণ, আপনাকে নিয়ে আমার অন্য প্ল্যান আছে, জিশান—মিস করেছি সেইজন্যে…।’
সঙ্গে-সঙ্গে মিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল। তারপর জিশানকে জাপটে ধরে ভয় পেয়ে কোণঠাসা আহত পশুর মতো হেঁচকি তুলে কাঁদছে।
‘…তা নইলে খুলি আর মাটির ভাঁড় আমার কাছে একই—ওদের জন্মই হয়েছে চৌচির হওয়ার জন্যে।’ হাসলেন শ্রীধর। পিস্তলটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে হাতুড়ি পেটার ঢঙে সবেগে বসিয়ে দিলেন জিশানের পাঁজরে।
জিশান কঁকিয়ে উঠল। যন্ত্রণায় ওর শরীরটা কুঁকড়ে গেল।
মিনি ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্রীধরের পায়ে। উপুড় হয়ে পায়ে মাথা ঘষতে-ঘষতে বলল, ‘প্লিজ, ওকে ছেড়ে দিন। ও ইচ্ছে করে কাউকে খুন করেনি। ইচ্ছে করে কাউকে খুন করেনি…।’
‘জানি তো, মা-মণি। শুধু-শুধু এমনধারা করছ কেন বলো তো? মরছ কেন মাথা খুঁড়ে আমার পায়ের পাতায়?’ গায়ে জ্বালা ধরানো ন্যাকা মেয়েলি ভঙ্গিতে বললেন শ্রীধর পাট্টা। ঝুঁকে পড়ে মিনিকে ধরে তুললেন মেঝে থেকে। দস্তানা পরা আঙুলের ডগা দিয়ে বেশ সময় নিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিলেন।
জিশান শুয়ে থাকা অবস্থাতেই দেখল দৃশ্যটা। ও ভাঙা গলায় চিৎকার করে উঠল, ‘স্টপ ইট! স্টপ ইট য়ু…।’
‘স্টপ ইট য়ু কী? বাস্টার্ড? নাকি বাংলায় তালব্য শ দিয়ে খুব কমন একটা যে গালাগাল আছে, সেটা দিতে যাচ্ছিলেন?’ কোমরে হাত রেখে তেরছা চোখে তাকালেন শ্রীধর পাট্টা : ‘আমি তো আপনার বউকে ছুঁইনি, বাবু। আপনার বউয়ের চামড়া আর আমার চামড়ার মাঝে দস্তানার কাপড়ের লেয়ার রয়েছে না! ন্যাকাবোকা! কিচ্ছু বোঝে না মাইরি!’
মিনিকে আলতো করে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে শ্রীধর বললেন, ‘জিশান পালচৌধুরী, শোনো। তোমাকে নিয়ে আমার প্ল্যানটা এবারে বলি। তোমার এগেইনস্টে যা চার্জ তাতে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট দেওয়া ছাড়া সিন্ডিকেটের কাছে আর কোনও পথ খোলা নেই। তবে তোমাকে বাঁচার একটা সুযোগ দেওয়া যায়…।’
থামলেন শ্রীধর পাট্টা।
আশায় মিনির চোখ চকচক করে উঠল। জিশানেরও।
‘…তোমাকে ”কিল গেম”-এ নাম দিতে হবে।’
শ্রীধরের শেষ কথাটা যেন বরফের ছুরি হয়ে কেটে বসল জিশানের মগজে।
আর মিনি পাথর হয়ে গেল।
শ্রীধর পাট্টা চুপচাপ চোয়াল শক্ত করে বসে রইলেন। তারপর শব্দ করে থুতু ফেললেন ঘরের মেঝেতে। ভুরু উঁচিয়ে বললেন, ‘ঘরটা যা নোংরা! এখানে ইজিলি থুতু ফেলা যায়, কী বলো?’
শেষ প্রশ্নটা জিশানকে লক্ষ করে। কিন্তু জিশান কোনও জবাব দিতে পারল না। কারণ, ও তখনও ‘কিল গেম’ নিয়ে ভাবছে।
‘কিল গেম’ খেলাটা গড়ে দু-মাসে একবার করে হয়। কারণ, সবসময় খেলোয়াড় পাওয়া যায় না। তা ছাড়া ওই খেলায় শুধু খেলোয়াড় পেলেই হল না, তার শারীরিক এবং মানসিক শক্তি পরীক্ষা করে দেখা হয়। নানারকম ডাক্তারি ও অন্যান্য পরীক্ষার পর যদি সে পরীক্ষায় পাশ করে, তবেই তাকে ‘কিল গেম’-এ নামার সুযোগ দেওয়া হয়।