লোকটা সামান্য হেসে জিশানের দিকে দু-পা এগিয়ে এল। পিস্তলের নলটায় এমনভাবে আঙুল বোলাতে লাগল যেন পোষা কুকুরের গলায় সুড়সুড়ি দিয়ে আদর করছে।
‘গুড ইভনিং, মিস্টার পালচৌধুরী, এভাবে হানা দিয়ে আপনাকে আচমকা চমকে দেওয়ার জন্যে মাপ চাইছি। আর একইসঙ্গে সাফ জানাই, আমরা পিস ফোর্সের কাট-পিস। প্র্যাকটিক্যালি ফোর্স করে আমাদের চার পিসকে এখানে পাঠানো হয়েছে—সিন্ডিকেটের ইন্ডিকেশানে। আমার নাম শ্রীধর পাট্টা। নিউ সিটির পিস ফোর্সের ক্রিমিনাল রিফর্ম ডিপার্টমেন্টের মার্শাল। বোঝেনই তো হালচাল!’
শ্রীধর পাট্টা কথা বলছিলেন চিবিয়ে-চিবিয়ে, আর একইসঙ্গে হাসছিলেন। ওঁর ফরসা মুখে অনেক ভাঁজ। সূচিতীক্ষ্ণ ভুরুর রেখা—দেখে মনে হয় প্লাক করা। ঠোঁটজোড়া টুকটুকে লাল এবং ঝকমক করছে। নিশ্চয়ই ফ্লুওরেসেন্ট লিপস্টিক লাগিয়ে এসেছেন।
শ্রীধর কথা বলছিলেন মেয়েলি টানে সুর করে। ওঁর দাড়ি-গোঁফ কামানো মসৃণ লম্বাটে মুখ আর লম্বা-লম্বা চুল মেয়েলি ভাবটাকে আরও জোরালো করেছে।
‘আমরা আপনাকে রিফর্ম করতে এসেছি, জিশান—তাই আপনাকে একটা ফর্ম ফিল-আপ করতে হবে। ভে-রি সিম্পল…আপনার ওয়াইফের গালে তো হেভি নাইস ডিম্পল! কমপ্লিমেন্টস, ম্যাডাম—’ মিনির দিকে ফিরে বললেন শ্রীধর, ‘তা আপনার ছানাটি তো বেশ!…বেশ ঘুম-ঘুম ছানা। বদন চাঁদপানা। কী নাইস ঘুমিয়ে রয়েছে!’
জিশান আর মিনি হতবাক হয়ে শ্রীধরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। জিশানের মাথার ভেতরে বনবন করে একটা মেরি-গো-রাউন্ড ঘুরতে শুরু করে দিয়েছিল। পিস ফোর্সের লোকজন কেন ওর বাড়িতে এসেছে সেটাই বুঝতে পারছিল না জিশান। তা ছাড়া মার্শাল, শ্রীধর পাট্টা, ঠিক কী যে বলতে চাইছেন তাও মাথায় ঢুকছিল না।
ঘুমন্ত শানুর মাথায় হাত ছোঁয়ালেন শ্রীধর, বললেন, ‘বে-বি! ছুইট বেবি। মিনিদেবী, আপনার পারমিশান নিয়ে আমি কি ওকে কোলে নিতে পারি?’
মিনি শ্বাস টানল শব্দ করে। শ্রীধরের ছোঁয়া থেকে এক ঝটকায় শানুকে সরিয়ে নিতে চাইল।
হেসে ফেললেন শ্রীধর। একঝাঁক কাচের চুড়ি এ ওর গায়ে ঢলে পড়লে যেমন রিনরিনে শব্দ হয়, অনেকটা সেইরকম শোনাল ওঁর হাসিটা। মিনির গালে দস্তানা পরা আঙুলের আলতো টোকা দিয়ে বললেন, ‘ও মা গো! মা ভয় পেয়েছে গো! ও. কে.—দেন য়ু গো, গো। য়ু গো টু নেক্সট রুম! আমরা আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাই—।’
মিনিকে ইশারা করে পাশের ঘরে যেতে বললেন শ্রীধর। পকেট থেকে একটা ছোট্ট শিশি বের করে তা থেকে দু-ফোঁটা তরল হাঁ করে মুখে ঢাললেন। জিভ টাকরায় ঠেকিয়ে স্বাদ নিয়ে ‘চকাস! চকাস!’ শব্দ করলেন দুবার। তারপর পলকে চাঙ্গা হয়ে উঠলেন।
জিশান আন্দাজ করল, ওই শিশিতে নেশা-ধরানো কোনও জিনিস রয়েছে। নিউ সিটিতে এরকম নতুন-নতুন বহু মাদক পাওয়া যায়।
মিনি জিশানের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোমার কাছে থাকব।’
জিশান ইশারায় ওকে শান্ত হতে বলল।
হঠাৎই মাথা ঝাঁকালেন শ্রীধর। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটের কয়েকটা কাগজ বের করলেন।
কাগজগুলো দোমড়ানো মোচড়ানো। পাতা উলটে-উলটে সেগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন তিনি। আর মুখে ‘উঁ-উঁ’ শব্দ করতে লাগলেন।
অবশেষে একসময় শ্রীধর পাট্টা হেসে উঠে বললেন, ‘গট ইট। আইটেম ভেরি হট। পড়ে ফেলি চটপট।’
একটা পৃষ্ঠা মুখের কাছে নিয়ে তিনি পড়তে শুরু করলেন।
‘জিশান পালচৌধুরী। বয়েস আটাশ। ওল্ড সিটি। সিটিজেনশিপ নাম্বার কে বাই এইচ 21034। ওয়াইফ মিনি। একমাত্র ছেলে অর্কনিশান—ডাকনাম শানু। চার্জ : উইলফুল মার্ডার অ্যান্ড ইল্লিগ্যাল গ্যাম্বলিং।’
থামলেন শ্রীধর। কালো য়ুনিফর্ম পরা তিনজনের একজনকে সদর দরজাটা দেখিয়ে চোখের ইশারা করলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে মরা মানুষটা রোবটের মতো এগিয়ে গেল ঘরের দরজার দিকে। রীতিমতো শব্দ করে দরজার পাল্লা দুটো ভেজিয়ে দিল।
‘এইবার আমরা স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারি। বাইরের কেউ আর আমাদের কথা শুনতে পাবে না—’ শ্রীধর ঘরের চারপাশে চোখ বোলালেন, বললেন, ‘আসুন, শ্রীপালচৌধুরী, বসে পড়া যাক এখানে-ওখানে। এখানে বসেই কাজের কথা হোক। আর শ্রীমতী পালচৌধুরী—’ মিনির দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে বললেন শ্রীধর পাট্টা, ‘আপনি স্বামীর কাছে থাকুন, তবে ছানাটাকে রেখে আসুন। নইলে কখন লোহার সঙ্গে খোকার ঠোকাঠুকি লেগে যায়…’ হাতের পিস্তলটা নাচিয়ে দেখালেন : ‘…কে বলতে পারে!’
ঘরটার অবস্থা নোংরা, ছন্নছাড়া। এলোমেলো দড়িতে উলটোপালটা জামাকাপড় ঝুলছে। দেওয়ালের তাকে পুরোনো বইপত্র, অচল ঘড়ি, গায়ে মাখার সাবান আর প্লাস্টিকের খেলনা।
একটা ভাঙা টুল নিয়ে বসে পড়লেন শ্রীধর—পায়ের ওপরে পা তুলে মডেলদের ভঙ্গিতে বসলেন।
জিশান মেঝেতে বসে পড়ল।
মিনি শানুকে পাশের ঘরে রেখে ফিরে এল—বসল জিশানের পাশে।
প্যাঁচাটা তা হলে এমনি-এমনি ডাকেনি! ভাবল মিনি।
জিশান স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকা তিনটে মৃতদেহের দিকে একপলক তাকাল। তারপর শুকনো ঠোঁটের ওপরে জিভ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, স-স-স্যার!’
কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটগুলো পকেটে ঢুকিয়ে হাসলেন শ্রীধর, বললেন, ‘কোনও চিন্তা নেই—আমি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। এত সুন্দর যে, আপনার বউয়ের চেয়েও সুন্দর—ঠিক আছে? গত শনিবার রাতে মানিকতলার খালধারে আপনি ইল্লিগ্যাল একটা ফাইট গেমে নাম দিয়ে গ্যাম্বল করেছেন—বে-আইনিভাবে জুয়া খেলেছেন। সেই সময়ে কার্তিক তপাদার নামে ওল্ড সিটির একজন সিটিজেনকে—সিটিজেনশিপ নাম্বার এল বাই ডি-76618—আপনি ইচ্ছে করে খুন করেছেন। উইলফুল মার্ডার।’