প্লাস্টিকের নকল পা।
একঘণ্টা ধরে রয়্যাল বেঙ্গলের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে একটা পা খুইয়েছেন সেন্টালি। অবশ্য তার জন্য সুপারগেমস কর্পোরেশনের সিস্টার কোম্পানি নিউলাইফ ইনশিয়োরেন্স সেন্টালিকে তিন লক্ষ টাকা দিয়েছে।
অর্ধেক ডান পায়ের দাম।
জ্ঞান ফিরে আসার পর সেন্টালি দেখেছিলেন, বাঘটা মাংস চিবোচ্ছে। আসলে বাঘটা তখন তাঁর কামড়ে কেটে নেওয়া ডান পা-টা চিবোচ্ছিল।
প্রাোমো দেখতে-দেখতে এতক্ষণ বেশ ভালোই লাগছিল জিশানের। প্রাোমোর সঙ্গে-সঙ্গে জাম্প কাট করে গেম শো-টার ফুটেজ দেখানো হচ্ছিল বারবার। মাঝে-মাঝে আবার স্লো মোশানে দেখানো হচ্ছিল, কী কায়দায় সেন্টালি বাঘের দাঁত-নখ এড়িয়ে বাঘকে ফাঁকি দিচ্ছেন।
টিভিতে সেসব দেখতে-দেখতে উত্তেজনা আর আনন্দে দর্শকরা হইহই করছিল, হাততালি দিচ্ছিল। কিন্তু একেবারে শেষে যখন সেন্টালির খোয়া যাওয়া পা-টা দেখানো হল, দেখানো হল বাঘের পা চিবিয়ে খাওয়ার দৃশ্য, তখন পলকে সব হইচই থেমে গেল।
জিশানের হাত ধরে হিংস্রভাবে টান মারল মিনি : ‘এক্ষুনি চলে এসো বলছি!’
জিশানের হঠাৎই গা গুলিয়ে উঠল। ও তাড়াতাড়ি সরে এল টিভির সামনে থেকে। প্রেজেন্টার মেয়েটি তখন বলছে, ‘ভাবুন তো! এ-খেলায় কী মারাত্মক থ্রিল! আর কী মারাত্মক পুরস্কার—প-ন-চা-শ ল-ক্ষ টা-কা! হোয়াও! আর তার সঙ্গে বোনাস ইনশিয়োরেন্সের তিন লক্ষ টাকা! ভাবা যায়!’
সত্যিই ভাবা যায় না! লোভের টোপ ফেলে সুপারগেমস কর্পোরেশন সেন্টালির ডান পায়ের অর্ধেকটা নিয়ে নিয়েছে। কে জানে, একটু এদিক-ওদিক হলে সেন্টালির প্রাণটাই হয়তো খরচের খাতায় জমা পড়ে যেত!
সেন্টালির পরই দেখা গেল আর-একজন সফল প্রতিযোগীকে। সে তার সাফল্যের সাতকাহন শুরু করতেই জিশান সরে এল। কারণ, মিনি ওকে টানতে-টানতে রাস্তা ধরে হাঁটা দিয়েছে। আর ওর ডান কাঁধের ওপরে মাথা রেখে ছোট্ট শানু ঘুমিয়ে পড়েছে।
আকাশের রং এতক্ষণে অনেকটা ছায়া-ছায়া ঘোলাটে হয়ে গেছে। ধূমকেতু দুটো ধীরে-ধীরে রঙিন এবং স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেদিকে তাকিয়ে জিশানের মন খারাপ হয়ে গেল। এইভাবে খেলতে-খেলতেই কি সবার জীবন শেষ হবে?
হাঁটতে-হাঁটতে ও মিনির দিকে তাকাল : ‘মিনি—।’
‘উঁ—।’ আনমনাভাবে শব্দ করল মিনি। ও পথচলা দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। বয়েস ওদের আট কি নয়। গায়ে ময়লা পোশাক। আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত বিড়ি। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে-করতে হেঁটে যাচ্ছিল। ওদের কথা যেটুকু শোনা গেল তাতে কানে আঙুল দিতে হয়।
কিন্তু আজকাল খুব একটা কেউ কানে আঙুল দেয় না—অনেকটা যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে।
জিশান আক্ষেপের একটা শব্দ করে বলল, ‘হুঁ:, এই আমাদের পরের জেনারেশান!’
মিনি বলল, ‘এর মাঝে আমাদের শানুকে বড় করে তোলা…আমার খুব ভয় করে।’
‘জানো, আমাদের ছোটবেলাটা এরকম ছিল না…মানে, এতটা খারাপ ছিল না।’
মিনি ম্লান হেসে বলল, ‘সব জানি।’ একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর : ‘তখন তো আর সুপারগেমস কর্পোরেশন ছিল না! আর এত প্রাইজ মানিও ছিল না।’
সত্যি, বাজি ধরা, জুয়া খেলা, যেন জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে! অথচ বাবা বলতেন, ‘শ্রমের মর্যাদা কখনও নষ্ট করবে না।’
হুঁ:! কোথায় শ্রম আর কোথায় মর্যাদা!
হাঁটতে-হাঁটতে নিজের পাড়ায় পৌঁছে গেল জিশান।
ভাঙাচোরা গলিপথের ওপরে দুপাশ থেকে ঝুঁকে রয়েছে জরাজীর্ণ একতলা সব বাড়ির কাঠামো। বাড়িগুলোর সর্বত্র জোড়াতালি দেওয়া। কালচে দেওয়াল। ফাটল ধরা দরজা-জানলা। দেখেই বোঝা যায়, এখানে যে-মহামারী রোগ ছড়িয়ে পড়েছে তার নাম অভাব।
গলিতে টিমটিম করে কয়েকটা বালব জ্বলছিল। সামনের একটা টিনের চালের আড়ালে প্যাঁচা বাসা বেঁধেছে। মাঝে-মাঝে রাতবিরেতে ওটা ডেকে ওঠে। মিনি বলে, প্যাঁচাটা খুব জাগ্রত—বিপদের গন্ধ পেলেই ডাক ছেড়ে গলির সবাইকে হুঁশিয়ার করে দেয়।
জিশান আর মিনি গলিতে পা রাখামাত্রই প্যাঁচাটা দুবার ডেকে উঠল।
মিনি কেঁপে উঠল। চকিতে তাকাল প্যাঁচাটার আস্তানার দিকে। অন্ধকারের ভেতরে সাদাটে পাখিটার নড়াচড়া অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল ও।
জিশান এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না। তাই মিনির মুখের চেহারা দেখে মজা করে হাসল।
ঠিক তখনই জিশান খেয়াল করল, আশেপাশের বাড়ির জানলা-দরজা ফাঁক করে কয়েকটা মুখ জিশানদের কৌতূহলে দেখছে।
কিন্তু কেন? ওরা তো জিশানদের প্রতিবেশী! রোজই দেখতে পায় জিশানদের। তা হলে আজ এত উঁকিঝুঁকি মারা কেন?
সেটা বোঝা গেল বাড়িতে ঢোকার পর।
ঘরে ঢুকতে গিয়ে জিশান দ্যাখে, ওদের ঘরে চারজন লোক এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের প্রত্যেকের হাতে নীল দস্তানা এবং নীল রঙের অটোমেটিক পিস্তল।
•
চারজনের মধ্যে তিনজন কালো রঙের য়ুনিফর্ম পরে রয়েছে। পোশাকে সোনালি বিডের লাইনিং। বুকে লাগানো সোনালি হলোগ্রাম ব্যাজ থেকে আলো ঝলসে বেরোচ্ছে। তার মধ্যে সুন্দর হরফে লেখা ‘পি.এফ.’—পিস ফোর্সের প্রথম দুটো অক্ষর। ওদের মুখগুলো মরা মানুষের মুখের মতো—অভিব্যক্তিহীন।
ওদের তিনজনের চোখই জিশানের দিকে। চোখের পাতা পড়ছে না।
চতুর্থজনের পোশাক ধবধবে সাদা। তাতে ঝকঝকে সোনালি বোতাম আঁটা। বুকপকেটের ওপরে জ্বলজ্বলে নীল হলোগ্রাম।