এইসব বিজ্ঞানের কচকচির পরই শুরু হল একটি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান: শার্ক ভার্সাস ডলফিন। একজন হাঙর বিশেষজ্ঞ এবং একজন ডলফিন বিশেষজ্ঞ মুখোমুখি বসে হাঙর এবং ডলফিনের আচার-আচরণ নিয়ে দুজন প্রেজেন্টারের সঙ্গে তুমুল আলোচনায় মেতে উঠলেন।
প্রাোমোর সবশেষে টিভিতে ফুটে উঠল নিয়মাবলী।
তাতে রয়েছে খেলার নানান শর্ত এবং কীভাবে প্রতিযোগীরা খেলাটায় নাম দেবে তার সুলুকসন্ধান।
মিনির আশেপাশে ভিড় করে থাকা লোকজন হাঁ করে প্রাোমো প্রাোগ্রামটা গিলছিল। ওদের অনেকের চোখ দিয়ে লালা ঝরছিল।
নিউ সিটির যে-দুজন এজেন্ট টিভির পাশে চুপটি করে বসে ছিল, তাদের ছেঁকে ধরল কয়েকজন। ‘হাংরি ডলফিন’ গেম নিয়ে প্রশ্নে-প্রশ্নে পাগল করে তুলল।
জিশান জানে, খেলাটায় সারভাইভাল ফ্যাক্টর 0.61। অর্থাৎ, না-বাঁচার সম্ভাবনা শতকরা ঊনচল্লিশ ভাগ। কিন্তু তা সত্বেও এই বিপজ্জনক খেলায় নাম দেবে অনেকে। তার কারণ, ঝুঁকি নিয়ে জুয়া খেলতে চাওয়া লোকের সংখ্যা ওল্ড সিটিতে খুব একটা কম নয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ হল লোভ—টাকা দিয়ে সুখ এবং আরাম কেনার লোভ। এই লোভের টোপ বড় সাংঘাতিক জিনিস।
মিনি জিশানের জামা ধরে টান মারল, বলল, ‘চলো, শানুর ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়লে আধ দুধ খেতে চাইবে না।’
জিশানের চোখ দেখে মিনির বুকটা কেঁপে উঠল। আশপাশের মানুষগুলোর চোখের সঙ্গে কিছুটা যেন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। না, আর বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়ানো ঠিক নয়।
মিনি দোটানায় দুলতে-দুলতে হঠাৎই যেন ঘোর কাটিয়ে জেগে উঠল। আর-একবার জিশানের হাত ধরে আলতো টান মারতেই জিশান বিরক্ত হয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল : ‘আ:! একমিনিট দাঁড়াও না!’
ততক্ষণে প্রাোমোর পরের অংশ শুরু হয়ে গেছে।
ওল্ড সিটির যেসব মানুষ সুপারগেমস কর্পোরেশনের অন্যান্য শো-তে নাম দিয়ে ভাগ্য ফেরাতে পেরেছে তাদের ফটোগ্রাফ দেখানো শুরু হল।
প্রথমে এল বছর পঁয়তিরিশ-ছত্তিরিশের একজন লোক। ঝকমকে পোশাক, চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা, ঠোঁটে সিগারেট, মুখে চওড়া হাসি।
ভদ্রলোকের নাম সেন্টালি মজুমদার। একটা সোফায় আরাম করে বসে আছেন। পায়ের কাছে একটা লোমওয়ালা পুঁচকে কুকুর। সামনের টেবিলে কফির কাপ।
ক্যামেরা ভদ্রলোকের ফ্ল্যাটটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাল। আর সেইসঙ্গে বলতে লাগল, সেন্টালি মজুমদার নিউ সিটির এই ফ্ল্যাটে কী আরামেই না আছেন! এই আরাম সেন্টালি কিনেছেন সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেম শো-তে নাম দিয়ে। এবং জিতে।
জিশান এই প্রাোমো দেখতে-দেখতে আরামের গন্ধ পাচ্ছিল। কয়েক লহমার জন্য আনমনা হয়ে গেল ও।
শুধু জিশান কেন, দর্শকদের আরও অনেকেই ওই আরামের সুবাস পাচ্ছিল।
প্রাোমো দেখতে-দেখতে হঠাৎই একটা ধাক্কা খেল জিশান।
কারণ প্রেজেন্টার মেয়েটি তখন বলছে, ‘…কিন্তু গেম শো-তে জেতার আগে কেমন ছিল সেন্টালি মজুমদারের জীবন? এবারে দেখুন, কোথা থেকে কোথায় এসেছেন তিনি!’
সঙ্গে-সঙ্গে ক্যামেরা দেখাতে শুরু করেছে ওল্ড সিটির একটা জঘন্য বস্তি অঞ্চল। নোংরা, অন্ধকার, ক্লেদাক্ত জীবনযাত্রার ভয়াবহ ছবি। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকসমেত প্রায় আধমিনিট ধরে সেগুলো দেখানো হল। তারপর টিভির ফ্রেমে ফিরে এল প্রেজেন্টার। দর্শকদের দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘আপনি কি চান না আপনার জীবনটাকে ফেরাতে? জীবন বদলানোর অধিকার সবার আছে—আপনারও। সেই বদলের জন্য নিতে হবে সামান্য ঝুঁকি। কী, পারবেন না একটু ঝুঁকি নিতে? আমাদের গেম শো-র সামান্য ঝুঁকির বিনিময়ে আমূল বদলে যেতে পারে আপনার জীবন।’
এরপর শুরু হল সেন্টালির ইনটারভিউ। গেম শো-তে ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষে অনেক ভালো-ভালো কথা বললেন সেন্টালি। শোনালেন ‘মাই লাইফ উইথ আ টাইগার’ গেম-এ তাঁর রোমাঞ্চকর লড়াইয়ের কাহিনি।
একটা বাঘের খাঁচায় তাঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল একটা ছোট হান্টিং নাইফ আর চোদ্দো কেজি মাংসের টুকরো। মোক্ষম সময়ে বাঘের মুখে বারবার মাংসের টুকরো ছুড়ে দিয়ে, খাঁচার জাল বেয়ে টিকটিকির মতো পালিয়ে বেড়িয়ে, তাঁকে একঘণ্টা বাঁচতে হয়েছিল। এই লড়াইয়ে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল সেন্টালির। মনের ওপরে কী সাংঘাতিক চাপই না পড়েছিল! একঘণ্টা পর যখন খাঁচার দরজা খুলে তাঁকে বের করা হয় তখন তিনি যন্ত্রণা আর টেনশানে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর তাঁর মনে হয়েছিল, বাঘের খাঁচার ব্যাপারটা সত্যি নয়—স্বপ্ন। কিন্তু খাঁচার ভেতরে তাকিয়ে দেখেছিলেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটা তখন মাংস চিবিয়ে খাচ্ছে। সেটা কিন্তু মোটেই স্বপ্ন ছিল না।
এই খেলায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা জিতেছেন সেন্টালি মজুমদার। তাঁর স্ত্রী আর দু-ছেলের তো আনন্দে পাগল হওয়ার জোগাড়। ওঁদের সবার জীবনটাই সেই মুহূর্ত থেকে বদলে গিয়েছিল।
ক্যামেরা এবার সেন্টালির পায়ের দিকে এগোল। সেন্টালি তাঁর প্যান্টের ডান পা-টা ওপরদিকে গোটাতে শুরু করলেন। ক্যামেরা ডান পায়ের ক্লোজ আপ শট দেখাচ্ছে। তাতে স্পষ্ট দেখা গেল, সেন্টালির ডান পায়ের গোলাপি রং চকচক করছে এবং সেই পায়ে একটাও লোম নেই।
পা-টা ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারলেন সেন্টালি। তাঁর ডান পা-টা হাঁটুর কাছ থেকে খুলে চলে এল হাতে।