মিনি তাকাল জিশানের দিকে। বলল, ‘করে। মাঝে-মাঝে সত্যি যেতে ইচ্ছে করে।’
‘বেড়াতে, না পাকাপাকিভাবে?’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল মিনি। চারপাশটা চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখল। তারপর ইতস্তত করে জিগ্যেস করল, ‘আমাদের এই শহরটার আর কিছু হবে না, না?’
মিনি শহরটাকে নিয়ে সবসময় খুব ভাবে।
জিশান ওর কথায় হেসে ফেলল। শানুকে মিনির কোলে দিল। একটা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘হওয়া তো দরকার। শহরটা আর বেশিদিন এরকম থাকলে আমরা সবাই খারাপ হয়ে যাব, মিনি।’
শানু মুখে আঙুল ঢুকিয়ে অর্থহীন কয়েকটা শব্দ করে উঠল। জিশানের মনে হল, বাচ্চাটা যেন বলছে, ‘ঠিক বলেছ!’
সত্যিই তো! এই বর্বর শহরটার চাপে পড়ে জিশানরা সবাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মিনি যদি পাশে না থাকত, এতদিনে জিশান কোথায় তলিয়ে যেত কে জানে! সেদিন যেভাবে কার্তিকের সঙ্গে লড়াইয়ের ব্যাপারটা হুট করে হয়ে গেল…যেভাবে চলে গেল মালিক…জিশানের বুকের ভেতরে তিন-চারদিন ধরে এক অস্থির তোলপাড় চলেছিল। মিনিকে আঁকড়ে ধরে অনেক চোখের জল ফেলেছে ও। ওর বারবার মনে হচ্ছিল, এক জিশান আর-এক জিশানের জন্য চোখের জল ফেলছে।
মিনি এমনিতে খুব চাপা ধরনের মেয়ে। বুঝতে পারে সবকিছু, কিন্তু সহজে ওর মুখ ফোটে না। সংসারের অভাব নিয়ে জিশানের নানান অভিযোগ আছে, কিন্তু মিনির কোনও অভিযোগ নেই। ওর কথা ভাবলেই মনে কেমন একটা জোর পায় জিশান।
সূর্য যত হেলে পড়ছিল, বাদল মেঘ ততই আকাশের দখল নিচ্ছিল। দুটো শুটার তীব্র শিস দিয়ে মাথার ওপরে উড়ে গেল। মিনি আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল, বলল, ‘এবার বাড়ি চলো। যদি পট করে বৃষ্টি এসে যায় তা হলে শানু ভিজে যাবে।’
জিশানও দেখল আকাশটাকে। এই একই আকাশ নিউ সিটির ওপরে। অথচ দুটো শহরে কত তফাত!
সামনেই একটা জটলা চোখে পড়ল ওদের। জটলাটা নিউ সিটির একটা ছোট ব্রাঞ্চ অফিসের সামনে।
শানুর পিঠ চাপড়াতে-চাপড়াতে মিনি জিগ্যেস করল, ‘কীসের ভিড় ওখানে?’
‘কে জানে! হয়তো নিউ সিটিতে কিছু কাজের লোক নেওয়া হবে—তারই অন-লাইন ফর্ম ফিল-আপ চলছে।’
সত্যি, এই শহরটা যেন শুধু চাকরবাকরদের শহর হয়ে গেছে! ভাবল জিশান।
মিনি বলল, ‘সুপারগেমস কর্পোরেশনের খেলায় নাম দেওয়ার ভিড়ও হতে পারে।’
‘হতে পারে—।’
‘চলো তো, কী খেলা দেখি। দেখি কত টাকা প্রাইজ মানি!’
জিশান ভেতরে-ভেতরে একটু দু:খ পেল। কৌতূহল আর লোভ। এই দুটো ব্যাপারকে উসকে দিয়ে সুপারগেমস কর্পোরেশন দিব্যি ব্যাবসা চালাচ্ছে। এ ছাড়া অভাব বড় সাংঘাতিক জিনিস। ভেতর থেকে মানুষকে ধীরে-ধীরে নরম করে দেয়।
ওরা হাঁটতে-হাঁটতে জটলার কাছে এগিয়ে গেল। আর তখনই ব্যাপারটা বুঝতে পারল।
সুপারগেমস কর্পোরেশন একটা নতুন খেলা লঞ্চ করছে। খেলাটার নাম ‘হাংরি ডলফিন’। প্লেট টিভিতে তারই প্রাোমো দেখানো হচ্ছে। দুজন প্রেজেন্টার খেলাটা সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
সমুদ্রের মধ্যে প্রকাণ্ড মাপের একটা খাঁচা ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই খাঁচায় ঘুরে বেড়াচ্ছে একডজন ডলফিন। তার মধ্যে ছ’টা ডলফিন আসলে হাঙর—তাদের বৈজ্ঞানিক কায়দায় ডলফিনের ছদ্মবেশ পরানো হয়েছে। এমন নিঁখুত ছদ্মবেশ যে, বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই।
এবারে এই খাঁচার মধ্যে নেমে পড়ছে একজন খেলোয়াড়। তাকে সাঁতার কেটে ঘুরে বেড়াতে হবে সেই খাঁচায়। এবং ছদ্মবেশী হাঙরের আক্রমণ থেকে বাঁচতে হবে। আত্মরক্ষার জন্য তাকে দেওয়া হবে দুটো ছুরি—একটা ছোট, একটা বড়। এ ছাড়া খেলোয়াড়ের কাছে থাকবে একটা ইলেকট্রনিক রিমোট কন্ট্রোল ইউনিট। সে রিমোট টিপে সংকেত পাঠালেই খাঁচার দরজা খুলে যাবে এবং খেলোয়াড় পালিয়ে বাঁচতে পারবে।
‘হাংরি ডলফিন’ খেলার মোট সময়সীমা কুড়ি মিনিট। যদি কোনও খেলোয়াড় কুড়ি মিনিট ওই খাঁচায় কাঁটিয়ে আহত কিংবা অক্ষত অবস্থায় বেঁচে ফিরে আসতে পারে, তা হলে সে পাবে বিশলাখ টাকা। যদি কেউ তার আগে খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসে, তা হলে তার পুরস্কার হল মিনিটপিছু এক লক্ষ টাকা। তবে কমপক্ষে পাঁচমিনিট খাঁচায় তাকে কাটাতেই হবে।
তারপরেই প্রেজেন্টাররা বলছে খেলার নানান শর্ত এবং নিয়মকানুন। বিশ লাখ টাকা প্রাইজ মানি দিয়ে নিউ সিটি থেকে কী-কী সুখ এবং আরাম কেনা যেতে পারে। কোথায়-কোথায় বেড়ানো যেতে পারে। কোন-কোন স্বপ্ন সত্যি হয়ে উঠতে পারে সফল প্রতিযোগীর জীবনে।
জিশান অবাক হয়ে দেখছিল।
সত্যি, সুপারগেমস কর্পোরেশনকে সেলাম জানাতে হয়। মাথা খাটিয়ে কী করে যে ওরা এতসব অদ্ভুত-অদ্ভুত খেলা বের করে কে জানে!
শানুকে কোলে নিয়ে এক্স-এক্স-এল সাইজের প্লেট টিভির দিকে তাকিয়ে ছিল মিনি। ওর চোখের পলক পড়ছিল না। খেলোয়াড়দের লোভ দেখানোর কায়দাটা দারুণ। ডলফিনের ছদ্মবেশে হাঙর। মিনিটপিছু একলক্ষ টাকা। কোনওরকমে পাঁচমিনিট কাটাতে পারলেই পাঁচ লাখ।
মিনি এমনিতে এসব খেলায় নাম দেওয়াটা খুব একটা পছন্দ করে না। কিন্তু বেশ কয়েকবছর ধরে অভাবের সঙ্গে লড়তে-লড়তে মাঝে-মাঝে ওর মনে হয়, এরকম দু-একটা খেলায় জেতার স্বপ্ন দেখলে ক্ষতি কী!
প্রেজেন্টার দুজন তখন ‘বার গ্রাফ’ আর ‘পাই চার্ট’ এঁকে খেলাটার অঙ্ক বোঝাচ্ছিল।
অর্থাৎ, একজন খেলোয়াড়ের প্রথম পাঁচমিনিট বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কত। তার পরের পাঁচমিনিটে সেই সম্ভাবনার মান কত হওয়ার সম্ভাবনা। কিংবা খেলোয়াড়ের আই. কিউ.-র সঙ্গে সারভাইভাল ফ্যাক্টরের সম্পর্ক কী। কী করে হাঙরের আক্রমণ এড়াতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।