কিন্তু জিশানও কি আর আছে! আগের জিশান?
দ্বিতীয়বার কান্না পেয়ে গেল জিশানের। এবারে নিজের জন্য। রাগে দু:খে এ কী করে বসল ও! অভাবের তাড়না ওকে রোজ কোণঠাসা করে তুলছিল ঠিকই, কিন্তু তাই বলে…!
পথ চলতে-চলতে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল জিশান। শুধু মালিক নয়, জিশানও আজ মারা গেছে। মারা যাওয়া অধ:পাতে যাওয়া এই জিশান এখন জুয়ায় জিতে সেই টাকায় ছেলের জন্য দুধ কিনতে যাচ্ছে।
এ-কথা ভাবার সঙ্গে-সঙ্গে ওর ভেতর থেকে কে যেন প্রতিবাদ করে উঠল : না, জুয়ায় জেতা টাকা নয়—পরিশ্রম দিয়ে উপার্জন করা টাকা। গায়ের শক্তি দিয়ে ও কার্তিককে হারিয়ে তারপর এই টাকা পেয়েছে।
তখনই ওর বুকের ভেতরে হেসে উঠল মালিক, বলল, ‘জিশু, এ আমার প্রাণের দাম। এতে কোনও পাপ নেই। এ-টাকা দিয়ে তুই শানুর জন্যে দুধ কিনে নিয়ে যা…মেয়েদের মতো কাঁদিস না সালা—।’
জিশান যন্ত্রণায় চোখ বুজল। ওর দু-চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
ততক্ষণে ও ওষুধের দোকানে পৌঁছে গেছে।
•
রোজ বিকেলে শানুকে কোলে নিয়ে বেড়াতে বেরোয় জিশান। এক-একদিন মিনিও ওর সঙ্গে থাকে। যেমন আজ।
রাতের অন্ধকারে ওল্ড সিটির চেহারা একরকম—কেমন যেন অপার্থিব, ছমছমে রহস্যে ঢাকা। আর দিনের চড়া আলোয় শহরটা কী কুৎসিত, হতমান!
শহরের বেশিরভাগ গাছপালাই নেড়া, তাতে কোনও ফুল-পাতা নেই। শুধু কঙ্কালটা কোনওরকমে দাঁড়িয়ে আছে। এমনকী বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, হাটবাজার, সবই ধুঁকছে—সেই সঙ্গে শহরের মানুষগুলোও। তবে মানুষগুলোর মধ্যে এখনও স্বপ্ন আছে। বেশিরভাগেরই স্বপ্ন নিউ সিটিতে যাওয়ার।
কিন্তু জিশান বা মিনির স্বপ্ন পুরোপুরি সেটা নয়। ওরা চায়, এই শহরটা আবার বেঁচে উঠুক—গাছপালা, বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, হাটবাজার, আর মানুষগুলোও বেঁচে উঠুক আবার। নানান রঙের ফুল আর পাখিরা ফিরে আসুক।
এখন তো পাখি বলতে শুধু কাক, চড়ুই, শালিখ, চিল আর শকুন—এ ছাড়া কখনও-কখনও ছিটকে চলে আসা দু-একটা পায়রা চোখে পড়ে। মউমাছি বা প্রজাপতি শেষ কবে দেখেছে জিশানের মনে নেই। আর ফুল? জংলা ঝোপ-ঝাড়ে দয়া করে যেটুকু যা ফুটে থাকে। নইলে রোজ বাগান করার শখের পয়সার জোগান দেবে কে!
নোংরা রাস্তার একপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ওরা। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। সেই আলো পড়েছে পুবে দাঁড়ানো নিউ সিটির গায়ে। শহরটা ঝলমল করছে। তার মাথায় অল্পবিস্তর শেষবর্ষার মেঘ। তার কিনারায় বিকেলের রং লেগেছে।
সেদিকে তাকিয়ে মিনি বলে উঠল : ‘কী দারুণ দেখাচ্ছে!’
জিশান বলল, ‘একদিন আমাদের শহরটাও ওরকম হবে।’
‘হবে তো?’ জিশানের দিকে তাকাল মিনি। ওর চোখে স্বপ্ন।
‘নিশ্চয়ই!’ বলে শানুর গালে একটা চুমু খেল জিশান।
শানুর চোখে কাজল, কপালে টিপ। ও জুলজুল করে বাবাকে দেখতে লাগল।
একটা ঝরঝরে গাড়ি ছুটে যাওয়ার সময় বৃষ্টির জল-ভরা খন্দে পড়ে লাফিয়ে উঠল। জিশান চট করে সরে যেতে চেষ্টা করল, কিন্তু পুরোটা এড়াতে পারল না। কাদা-জল ছিটকে এল ওর গায়ে।
মিনি বলল, ‘ইস, ভালো জামাটা নষ্ট হয়ে গেল।’
জিশান কোনও জবাব দিল না। ওর ভালো জামা-প্যান্ট বলতে আজকের পোশাকটাই সম্বল। বাকি আর যা-কিছু আছে সেগুলো দিনের বেলায় না পরাই ভালো।
পোশাকের ব্যাপারে মিনির অবস্থাও একইরকম। তবে রাতে ওকে বেরোতে হয় না কখনও। কারণ, অন্ধকার হয়ে গেলে জিশানই ওকে বেরোতে দেয় না। ভয়ের এই শহরে রাতে মেয়েরা একরকম বেরোয় না বললেই চলে।
জিশানরা আনমনাভাবে হেঁটে যাচ্ছিল। ডানদিকে, খানিকটা দূরে, একটা খাল। খাল না বলে পরিখা বলাই ভালো। কারণ, ওই পরিখা ওল্ড সিটি আর নিউ সিটিকে আলাদা করে রেখেছে। দুটো শহরের মধ্যে যোগাযোগ বলতে একটা ইস্পাতের সেতু—তার নাম ‘মাস্টার ব্রিজ’। ব্রিজের দুপাশে দুটো প্রকাণ্ড লোহার দরজা। দরকার পড়লে ওই দরজা খুলে নিউ সিটি থেকে ‘পিস ফোর্স’ আসে ওল্ড সিটিতে। এই শহরে ওদের অনেকগুলো যোগাযোগ অফিস আছে। আর একটা হেডঅফিস। সেই অফিসের মাধ্যমে ওরা নিউ সিটির জন্য ‘কাজের লোক’ জোগাড় করে। আর ইচ্ছে করলে ওইসব অফিসে যোগাযোগ করেও নানান গেম শো-তে নাম দেওয়া যায়।
মাস্টার ব্রিজের নিরাপত্তার জন্য পিস ফোর্সের লোক তো আছেই, তা ছাড়া আছে নানানরকম অটোমেটিক কন্ট্রোল। মাস্টার ব্রিজের কন্ট্রোল সিস্টেম অকেজো করে কারও পক্ষে ওই জোড়া লোহার দরজা ভেঙে নিউ সিটিতে ঢোকা সম্ভব নয়।
আর যদি কেউ সাঁতরে পরিখা ডিঙিয়ে নিউ সিটিতে যাওয়ার কথা ভাবে!
সেটাই হবে তার জীবনের শেষ ভাবনা।
কারণ, পরিখার দু-পাড়ের খাড়া দেওয়াল কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো। আর জল শুরু হয়েছে পঁচিশ ফুট নীচে।
সেই জলে কিলবিল করছে বিষধর সাপ আর পিরানহা মাছ। ওরা সবসময় জল পাহারা দেয়। ওই জলের উষ্ণতা, নোনাভাব, সবকিছুই সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
মাস্টার ব্রিজ কিংবা পরিখার নিরাপত্তার কথা ওল্ড সিটির বহু জায়গায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জাহির করা আছে—এই শহরের বাসিন্দাদের সাবধান করার জন্য।
সেইরকম একটা বিজ্ঞাপন পরিখার কিনারায় দেখতে পেল জিশান। বিশাল-বিশাল ফ্লুওরেসেন্ট হরফে রং-বেরঙের বিজ্ঞাপন।
নিউ সিটিতে এত নিরাপত্তা যে, ওল্ড সিটিতে তার ছিটেফোঁটাও নেই। এ-কথা ভেবে তেতো হাসি পেয়ে গেল জিশানের। ও মিনিকে জিগ্যেস করল, ‘নিউ সিটিতে যেতে ইচ্ছে করে?’