রহস্যের বেড়াজালে
দিনের আলো সত্যিই মানুষকে হারানো সাহস ফিরিয়ে দেয়। হাতিঘাস, ফার্ন, রঙিন পাতাওয়ালা মানকচুজাতীয় গাছের ঝোপ, বুগেনভিলিয়া আর রংবেরঙের নাম-না-জানা ফুলের জঙ্গল পেরিয়ে সেই ঝরনাধারার পাশে আমাদের দুটো ক্যাম্প পাতা হয়েছিল। উত্তরে ছটফটিয়ে চলা ঝরনাধারার ওপারে এবং ক্যাম্পের পশ্চিমে নিবিড় নারকোলবন। সামনে দক্ষিণে রবারগাছের জঙ্গল। ব্রেকফাস্ট করে কর্নেল এবং ডঃ ভাস্কো গার্ড তিকিকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলেন। এঁদের হাতে প্রজাপতিধরা জাল দেখে বুঝলাম, প্যাঁচা প্রজাপতির খোঁজে যাচ্ছেন।
কর্নেল আমাকে এবং হালদারমশাইকে ক্যাম্প ছেড়ে যেতে নিষেধ করেছিলেন। না করলেও অন্তত আমি এক পা বাড়াতে রাজি নই। আইউং কিছুক্ষণ দোনামনা করার পর একটা সাঁড়াশি এবং বস্তা হাতে নারকোলবনের দিকে চলল। ওর পিঠে গোঁজা লম্বাটে একটা দা। কোয়া তাহিতি ভাষায় ওকে কিছু বলল। কিন্তু আইউং যেন নারকোলখেকো কাঁকড়ার নেশায় আচ্ছন্ন। কোয়ার কথা গ্রাহ্য করল না।
হালদারমশাই বাইনোকুলারে চারদিক দেখছিলেন। হঠাৎ বললেন, ওগুলি কী ফল? বাতাবি লেবু নাকি? বলেই কোয়াকে জিজ্ঞেস করেলেন, হোয়াট ইজ দ্যাট ফুট! বিগ ট্রি অ্যান্ড বিগ ফুট!
কোয়া জিভে একটা শব্দ করে বলল, ব্রেডফুট! ডেলিশাস মিস্টার!
কয় কী জয়ন্তবাবু? রুটিফল? গাছে রুটি ধরে নাকি? রূপকথায় যা শুনেছিলাম, তা দেখি সত্যি। সেই যে একটা রাখাল পিঠে পুঁতেছিল। তা থেকে পিঠেগাছ হল। পড়েননি?
বললাম, পড়েছি। তারপর এক রাক্ষসী বুড়ি সেজে এসে পিঠে চাইল। রাখাল যেই তার হাতে পিঠে দিয়েছে, বুড়ি তাকে খপ করে ধরে ঝুলিতে পুরেছে। কাজেই সাবধান!
হালদারমশাই খি খি করে একচোট হাসলেন। তারপর ফের বাইনেকুলারে রবারগাছের জঙ্গলের পাশে ব্রেডফুট গাছটা দেখতে লাগলেন। একটু পরে দেখি, উনি বাইনোকুলার নামিয়ে পকেট থেকে রিভলভার বের করে এগিয়ে যাচ্ছেন। বললাম, হালদারমশাই, হালদারমশাই, কোথায় যাচ্ছেন?
একখান পিঠা না খাইয়া ছাড়ুম না!
যাবেন না। হয়গ্রীব ওত পেতে আছে।
কোয়া চেঁচিয়ে উঠল, ডােন্ট গো মিস্টার!
গোয়েন্দাপ্রবর কানে নিলেন না। লম্বা পায়ে এগিয়ে গেলেন। গাছটা অন্তত পঞ্চাশ মিটার দূরে। হঠাৎ ওঁকে একটা পাথরের আড়ালে বসে পড়তে দেখলাম। তারপর গুড়ি মেরে রবারগাছের জঙ্গলে ঢুকললেন। উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, কোয়া, দেখো তো উনি কোথায় গেলেন।
কোয়া নির্বিকার মুখে বলল, আমি ক্যাম্প ছেড়ে নড়ব না। আমার চাকরি যাবে।
কী করব ভাবছি, সেইসময় ঝরনার দিক থেকে আইউং ছুটে এল। তার হাতে সেই ধারালো দা। ভয়ার্ত মুখে সে কোয়াকে কিছু বলল। কোয়া রাইফেল বাগিয়ে ঝরনার দিক করে দাঁড়াল। বললাম, কী হয়েছে মিঃ আইউং?
ঘোড়া-মুখো দানো! ঝরনার ওপারে ঝোপের ভেতর মুখ বের করে উকি দিচ্ছিল।
বলেন কী।
হ্যাঁ মশাই! আমি স্পষ্ট দেখেছি। চারটে কাঁকড়া ধরেছিলাম। বস্তা আর সাঁড়াশি ফেলে পালিয়ে এসেছি।
আমি হালদারমশাইয়ের জন্য উদ্বিগ্ন। বললাম, কর্নেল এবং ডঃ ভাস্কো ফিরে আসুন। তারপর আপনার সাঁড়াশি ও বস্তা উদ্ধার করা যাবে। কিন্তু এদিকে এক কাণ্ড!
কোয়া তাহিতি ভাষায় ওকে কিছু বলল। আইউং আমার দিকে ঘুরে বলল, দানোটা ঝরনার ওপারে আছে। কাজেই আপনাদের সঙ্গী ভদ্রলোকের কোনও ভয় নেই। উনি হয়তো খরগোশ দেখেছেন। খরগোশের মাংস সুস্বাদু!
মরিয়া হয়ে এগিয়ে গেলাম। রবারবনের কছে গিয়ে ডাকলাম, হালদারমশাই, হালদারমশাই!
কোনও সাড়া এল না। আরও কয়েকবার ডাকাডাকি করে ক্যাম্পে ফিরলাম। বরাবর দেখে আসছি, অত্যুৎসাহী এই প্রাইভেট ডিটেকটিভ কেলেঙ্কারি না বাধিয়ে ছাড়েন না। কোয়া তার ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ইটিং ব্রেডফুট। শিওর!
বললাম, কিন্তু ডাকাডাকি করে কোনও সাড়া পেলাম না। হয় তো–
আমার কথার ওপর আইউং বলল, পাকা ব্রেডক্রুট খেলে ভীষণ ঘুম পায়।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল এবং ডঃ ভাস্কো ঝরনার দিক থেকে ফিরে এলেন। আইউং হাউমাউ করে ঘোড়া-মুখো দানোর খবর দিল এবং তার সাঁড়াশি-বস্তা উদ্ধারের জন্য কাকুতিমিনতি শুরু করল। ডঃ ভাস্কো বললেন, কোয়া, তুমি আইউংয়ের সঙ্গে গিয়ে ওর জিনিসগুলো উদ্ধার করো।
ইতিমধ্যে কর্নেলকে আমি হালদারমশাইয়ের দুঃসংবাদ দিয়েছি। কর্নেল ডঃ ভাস্কোকে ঘটনাটা জানিয়ে ব্যস্তভাবে বললেন, মিঃ হালদার সম্ভবত পেদ্রোর খুনি কিংবা তার দলের কাউকে অনুসরণ করেছেন। আমাদের এখনই ওঁর খোঁজে যেতে হবে।
ডঃ ভাস্কো ক্যাম্পে ঢুকে একটা রাইফেল নিয়ে এলেন। বললেন, তিকি তুমি আমাদের সঙ্গে এসো। কোয়া এখনই ফিরে আসবে।
রবারগাছের জঙ্গল এমন নিবিড় আর দুর্ভেদ্য যে, কয়েকগজ এগিয়ে ডাইনে ব্রেডফুট গাছের জঙ্গলে ঢুকতে হল। কর্নেল বাইনোকুলারে গাছপালার ফাঁক দিয়ে কিছু দেখার পর বললেন, একটা পাথরের শৈলশিরা দেখতে পাচ্ছি। ওই শৈলশিরার নিচেই কি সমুদ্র?
ডঃ ভাস্কো সায় দিলেন। দ্বীপের শেষ সীমানা ওটা।
কর্নেল সতর্ক দৃষ্টিতে হালদারমশাইয়ের গতিবিধির সূত্র খুঁজতে খুঁজতে হাঁটছিলেন।-পাশে একটা নারকোল বনে অনবরত পটকা ফাটার শব্দে চমকে উঠেছিলাম। তারপর বুঝলাম, শুকনো নারকোল খসে পড়ছে। এবার ফার্ন আর বুগেনভিলিয়ার জঙ্গল পেরিয়ে ঢালু হয়ে ওপরে ওঠা মোটামুটি ভোলামেলা বিস্তীর্ণ জায়গা। নানা গড়নের পাথর, ঘাস আর ফলের হাসিতে ঝলমলে ঝোপঝাড়। কর্নেল হঠাৎ একখানে থেমে বললেন, ওই দেখুন ডঃ ভাস্কো! প্যাঁচা প্রজাপতির আঁক!