নাহ! আলোটা টর্চেরই।
কে এমন দুঃসাহসী যে কোকো দ্বীপে টর্চ জ্বেলে ঘুরে বেড়ায়?
সঙ্গে দলবল এবং অস্ত্রশস্ত্র থাকলে দুঃসাহসী হওয়া মানুষের স্বভাব, ডঃ ভাস্কো! কর্নেল চুরুট ধরালেন। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, ওই বিচ দিয়ে দ্বীপে ওঠা উচিত হবে না। আইউংকে ডেকে পরামর্শ করা যাক।
ডঃ ভাস্কোর ডাকে আইউং এল এঞ্জিনঘর থেকে। কর্নেল সেই ম্যাপটা বের করে টেবিলে বিছিয়ে বললেন, ভাই আইউং, এই বিচ ছাড়া অন্য কোথাও কি কোকো দ্বীপে ওঠা যায় না?
আইউং বলল, বিচের উত্তরে একটা শাড়ি আছে। খাড়িটা বড়-বড় পাথরে ভর্তি। পাথরগুলো এড়িয়ে আপনাদের ভেলা যদি কিনারায় পৌঁছতে পারে, খানিকটা ঢালু জায়গা পাবেন। কিন্তু ঢালু জমিটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। তা ছাড়া পাশেই একটা ছোট্ট প্রপাত দেখেছি। প্রপাতের জল সমুদ্রে পড়ে হুলা-হুলা নাচছে। এই মুলুকেরই নাচ কিন্তু!
ডঃ ভাস্কো ম্যাপে আঙুল রেখে বললেন, এই সে প্রপাত। আসলে দ্বীপে একটা মিঠে জলের প্রস্রবণ আছে। সেটা সরু ঝরনার মতো নেমে এসেছে। আমরা জানুয়ারি মাসে গিয়ে সেখান থেকেই পানীয় জল আনতাম। তো এই খাড়ি দিয়ে পেঁৗছতে পারলে বরং ঝরনার ধারেই জঙ্গল কেটে ক্যাম্প করা যাবে। সেবার শুধু একটাই সমস্যা ছিল। নারকোলবনের ভেতর দিয়ে মাথা বাঁচিয়ে জল আনতে হত। কারণ ক্রমাগত শুকনো নারকোল বোমার মতো মাথায় পড়ত। মাথায় হেলমেট পরে যেতেই হত। নইলে খুলি ফেটে মরার আশঙ্কা ছিল। আর সে কী বিচ্ছিরি ফট ফট শব্দ! জানেন কর্নেল সরকার? পাথরে নারকোল পড়ে ফেটে যায়। সেই নারকোল-শাঁস খেতে আসে আঁকে-ঝকে রাক্ষুসে সামুদ্রিক কাঁকড়া, সে-ও আর এক উপদ্রব!
আইউং প্রায় নেচে উঠল। বাহ, আমারও আপনাদের সঙ্গী হতে ইচ্ছে করছে। ওই কঁকড়ার নাম নারকোল-কাঁকড়া। খুব সুস্বাদু! এক বস্তা ধরতে পারলে রাজা হয়ে যাব। তবে বেজায় ধূর্ত ব্যাটাচ্ছেলেরা! দেখি, চিচিনের সঙ্গে পরামর্শ করে আসি।
বুড়ো এঞ্জিনঘরে চলে গেল। হালদারমশাই ততক্ষণে বাথরুম থেকে বেরিয়ে মেঝেয় কম্বল পেতে চিত হয়েছেন। তাঁর শোচনীয় অবস্থা দেখে ডঃ ভাস্কো তাকে ওষুধ খাইয়ে দিলেন।
কর্নেল ম্যাপের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। আইউং ফিরে এসে বলল, চিচিন রাজি হচ্ছিল না। ওকে অনেক বুঝিয়ে একটা শর্তে রাজি করালাম। বললাম, সরকারি বড়কর্তারা এবং সশস্ত্র রক্ষী আছে। সাংঘাতিক জন্তুটাকে মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে। তো ওই খাড়িতে ট্রলার ঢোকানো যাবে না। পাশের একটা খাড়িতে চিচিন ট্রলার নোঙর করে রাখবে। কিন্তু চিচিনের একটা রাইফেল আর ডজনচারেক গুলি দরকার। এই হল ওর শর্ত।
ডঃ ভাস্কো বললেন, এখনই দিচ্ছি। আমরা অনেক অস্ত্র এনেছি।
আবার প্রোগ্রাম বদলানোর দরুন আধঘন্টা দেরি হল। ট্রলারের এঞ্জিন যখন বন্ধ হল এবং ঘড়ঘড় শব্দে নোঙর পড়ল, তখন রাত সাড়ে তিনটে বাজে। দড়ির সিঁড়ি বেয়ে রবারের দুলন্ত ভেলায় নামা এক বিপজ্জনক কসরত। অবাক হয়ে দেখলাম, সি-সিকনেস-এ কাহিল হালদারমশাই অক্লেশে ভেলায় অবতরণ করলেন। পুলিশ-ট্রেনিং সম্ভবত এর কারণ। তারপর বৈঠা টানতেও তিনি দক্ষ। তার কারণ সম্ভবত তার অতীত জীবন, যা নদ-নদীর দেশ পূর্ববঙ্গে কেটেছে।
আইউং নিজের পেলিনেশীয় ক্যাননা নামিয়েছিল। ছিপনৌকোর গড়ন সেই ক্যানোতে মাছধরা জাল ছিল। বড়-বড় পাথর এড়িয়ে ঢেউয়ের নাগরদোলায় কীভাবে কিনারায় পৌঁছেছিলাম, বলতে পারব না। আমি সারাক্ষণ চোখ বন্ধ করেছিলাম। লোনা জলে পোশাক ভিজে জবুথবু অবস্থা। হালদারমশাইকে বলতে শুনলাম, হাঙর গেল কই? বুড়া কইছিল হাঙর আছে। হঃ!
তারপরই যেন একটা হুলস্থূল বেধে গেল। সমুদ্র আর প্রপাতের গর্জন ছাপিয়ে হঠাৎ হাজার-হাজার সামুদ্রিক পাখির চিৎকার শুরু হল। আবছা জ্যোৎস্নায় তাদের ওড়াউড়ি দেখতে পেলাম। আইউং ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল, ওরা তো এখন ঘুমিয়ে থাকে। কেন ওরা জেগে উঠল? মশাইরা, সাবধান হোন! সাংঘাতিক দালোটা নিশ্চয় আমাদের সাড়া পেয়েছে। আমি শুনেছি, সে যেখানে যায়, সেখানকার ঘুমন্ত পাখিরা ভয় পেয়ে পালাতে থাকে।
ডঃ ভাস্কো ব্যস্তভাবে বললেন, কোয়া! তিমি! হ্যান্ডগ্রেনেড হাতে নাও।
কর্নেল খাড়ির দিকে ঘুরে পাখিদের ওড়াউড়ি দেখছিলেন। বললেন, আশ্চর্য তো! হঠাৎ ভয় পেল কেন ওরা? পাখিগুলো সি-গাল। সারারাত ওরা ঘুমিয়ে থাকে।
ফিকে জ্যোৎস্নায় লক্ষ করলাম, পাখির ঝাঁক। খাড়ি থেকে দ্বীপের ওপর কিছু অংশ জুড়ে চক্কর দিচ্ছে, হাজার-হাজার পাখি মিলে যেন একটা বিশাল কালো চাকা অদ্ভুত শব্দে ঘুরপাক খাচ্ছে।
কর্নেলের পাল্লায় পড়ে জীবনে অনেক বিপজ্জনক অবস্থায় কাটিয়েছি, যখন সব সাহস উবে গিয়ে আতঙ্কে রক্ত ঠাণ্ডা হিম হয়ে গেছে। কিন্তু কোকো দ্বীপে পা দিয়েই যে আতঙ্কের মধ্যে কিছু
সময় কাটিয়েছিলাম, জীবনে তা ভুলব না।
আমরা কর্নেলের নির্দেশে গুঁড়ি মেরে বসে পড়লাম। উনি টর্চ জ্বালতে নিষেধ করেছিলেন। আমরা আছি ঢালু জমির নিচে এবং ওপরে ঘন ঝোপঝাড়। কোয়া এবং তিকির এক হাতে দুর্ধর্ষ কালাশকিভ রাইফেল, অন্য হাতে গ্রেনেড। তারা আমাদের সামনে একটা পাথরের দুপাশে হাঁটু দুমড়ে বসেছে। প্রতি মুহূর্তে ঘোড়া-মুখো দানবটার আবির্ভাব আশঙ্কা করছিলাম।
কতক্ষণ পরে কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সি-গালগুলো চুপ করেছে। ওরা ডেরায় ফিরে গেছে কিন্তু আমাদের আপাতত এখানেই অপেক্ষা করা উচিত। ভোরের আলো ফুটলে আমরা রওনা হব। তবে সত্যিই এ একটা রহস্যময় ঘটনা। হঠাৎ ওরা ভয় পেল কেন?