সাড়ে-আটটার সময় কর্নেলের নির্দেশে হালকা জ্যাকেটটা খুলে পুরু জ্যাকেট পরে নিলুম। তারপর চণ্ডীবাবু এলেন। দেখলুম তিনি ওভারকোট পরেছেন এবং মাথায় টুপি, মুখে পাইপ। বললুম,–মিস্টার রায়চৌধুরীকে যেন শার্লক হোমস বলে মনে হচ্ছে।
তিনি একটু হেসে বললেন,–হোমসসাহেব কি আমার মতো হাতে রাইফেল নিয়ে ঘুরতেন?
ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। চণ্ডীবাবু আমাদের থানায় পৌঁছে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। দেখলুম ওসি প্রণবেশ সেন কয়েকজন অফিসারসহ থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি কর্নেল এবং আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন,–চলুন বেরোনো যাক।
রাস্তায় বাতিগুলো কুয়াশায় স্নান হয়ে আছে। নির্জন রাস্তা। আঁকাবাঁকা পথে ঘুরতে-ঘুরতে এক জায়গায় গাড়ি থেমে গেল। মিস্টার সেন চাপাস্বরে বললেন,–আর দু-মিনিট। তারপরই লোডশেডিং হবে।
বুঝলুম বিদ্যুৎ অফিসকে বলে রেখেছেন মিস্টার সেন।
তারপর ঠিকই লোডশেডিং হল। রাস্তার আলোগুলো নিভে গেল। কুয়াশা-নামা অন্ধকারে বুঝতে পারছিলুম না কোথায় এসেছি। একটু পরেই জায়গাটা চিনতে পারলুম। আমরা চাটুজ্যেবাড়ির মন্দিরের কাছে এসেছি। একদল পুলিশ বাড়িটার চারদিক ঘিরে ফেলল।
এরপর আমরা কয়েকজন মন্দিরের চত্বরে গেলুম। ঠিক তখনই কানে এল দেওয়ালের ওপাশে ঘসঘস করে চাপা শব্দ হচ্ছে। তারপর কানে এল বাড়ির সদর দরজার দিকে কেউ কড়া নাড়ছে।
শচীনবাবুর কণ্ঠস্বর কানে এল এবং টর্চের আলো দেখতে পেলুম। এদিকে কর্নেল আমাকে কাঁধে হাত রেখে দরজার পাশে গুঁড়ি মেরে বসিয়ে দিয়েছেন। অন্যপাশে মিস্টার সেনও বসেছেন। তারপর হঠাৎ এদিকের দরজাটা খুলে গেল। আবছা দেখলুম একটা লোক বেরিয়ে আসছে। অমনি তার মুখে টর্চের আলো ফেলে ওসি মিস্টার সেন বললেন, শরদিন্দুবাবু, আপনাকে অ্যারেস্ট করা হল।
তারপর একটা ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। ততক্ষণে আরও টর্চের আলো জ্বলে উঠেছে। দেখলুম চণ্ডীবাবুর মতোই ওভারকোট পরা এবং মাথায় হনুমান টুপি পরা তাগড়াই চেহারার ভদ্রলোকের হাতদুটো পেছন দিকে টেনে একজন অফিসার হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। তিনি চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন, কিন্তু তাকে ঠেলতে-ঠেলতে পুলিশ অফিসাররা প্রিজন ভ্যানের দিকে নিয়ে গেলেন।
কর্নেলের পেছনে-পেছনে আমি বাড়িতে ঢুকলুম। তারপর দেখলুম বিকেলে-দেখা সেই সাধুবাবাকে পুলিশ হাতকড়া পরিয়েছে। কর্নেল জবাগাছটার দিকে টর্চের আলো ফেললেন। সেখানে একটা শাবল পড়ে আছে। খানিকটা জায়গায় মাটি খোঁড়া।
শচীনবাবু এগিয়ে এসে বললেন, কী আশ্চর্য! এই সাধুকেই তো একবার সঙ্গে নিয়ে ছোটকাকা আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন।
আমি অবাক হয়ে কর্নেলকে জিগ্যেস করলুম,–তাহলে আপনি যে বলেছিলেন, ওই সাধুবাবাই মহীনবাবু?
কর্নেল বললেন, আমার অঙ্কে এই জায়গায় একটু গণ্ডগোল হয়েছিল, কিন্তু—
বলেই তিনি ওসি মিস্টার সেনকে বললেন,–ওই পুরোনো বাড়িটা পুলিশ ঘিরে রেখেছে তো?
মিস্টার সেন বললেন, হ্যাঁ। চলুন এবার শিগগির সেখানে যাওয়া যাক।
আমরা পাশের গলি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে সেই পোড়ো জমিতে পৌঁছুলুম। ভেতরে একটা ধস্তাধস্তির শব্দ হচ্ছিল। একজন অফিসারের কাঁধের ধাক্কায় এদিকের দরজাটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। তারপর ঘরে ঢুকে টর্চের আলোয় দেখলুম হালদারমশাইয়ের সঙ্গে একটা লোকের মল্লযুদ্ধ হচ্ছে।
হালদারমশাই এবার তাকে ছেড়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন,–কর্নেলস্যার এই হইল গিয়া ঘরের শত্রু বিভীষণ।
এতক্ষণে চণ্ডীবাবু উলটো দিক থেকে দৌড়ে এসে বললেন,–এ কী! মণি তুমি এখানে কেন? তোমার চ্যালারা কোথায়? বুঝেছি, তুমি এখানে আড়ি পেতে বসে চ্যালাদের চাটুজ্যেবাড়িতে হানা দিতে পাঠিয়েছিলে।
ওসি প্রণবেশ সেনের নির্দেশে পুরু সোয়েটার আর হনুমান টুপি পরা এক ভদ্রলোককে একজন অফিসার বললেন, আপনি আমাদের সম্মানিত অতিথি। প্লিজ, রাজনীতির ভয় দেখাবেন না। আমাদের সঙ্গে চলুন।
বলে তাঁর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন।
চণ্ডীবাবু বললেন,–উঠোনের কোণে বেচারা মহীন লুকিয়ে বসেছিল। তাকে কনস্টেবলরা ধরেছে। চলুন সেখানে যাওয়া যাক।
ভেতর দিকের উঠোনে নেমে দেখলুম, দেখতে শচীনবাবুর মতো চেহারার এক ভদ্রলোক বোবার চোখে তাকিয়ে আছেন। এত শীতেও তার গায়ে একটা গেরুয়া ফতুয়া আর পরনে খাটো ধুতি। তিনি চণ্ডীবাবুর দিকে তাকিয়ে কাঁদো-কাঁদো মুখে বললেন,–আমি অতশত কিছু ভাবিনি। শরদিন্দুদা মাঝে-মাঝে আমাকে ডেকে পাঠাতেন, আর বলতেন মণিবাবুর বাড়ি যাবি আর তিনি যা বলবেন, তাই করবি।
কর্নেল বললেন,–তাই আপনি রাতবিরেতে ঢিল ছুঁড়তেন, আর পাগলা বিনোদের মরা সেজে ভয় দেখাতেন।
শচীনবাবুর কাকা মহীনবাবু হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কর্নেল বললেন,–চলো জয়ন্ত, আসুন হালদারমশাই, আশাকরি আপনাকে ঘুসি খেতে হয়নি?
হালদারমশাই হাসবার চেষ্টা করে বললেন, না। আমি দরজায় আস্তে কড়া নাড়সি, আর সে টর্চের আলোয় আমারে দেইখ্যা ঝাপাইয়া পড়সে।
সে-রাত্রে চণ্ডীবাবুর বাড়িতে গিয়ে কফি খেতে-খেতে কর্নেলকে জিগ্যেস করেছিলুম,–সোনার মোহর ভরতি ঘড়াটা উদ্ধার করবেন না?
কর্নেল কিছু বলার আগেই চণ্ডীবাবু বললেন,–ওই কাজটা পুলিশের। সত্যি ওখানে সোনার মোহর ভরা ঘড়া পোঁতা আছে কি না তা পুলিশ খুঁজে দেখবে। আইন অনুসারে সত্যি সেটা পাওয়া গেলে তার মালিক হবে দেশের সরকার। কারণ ওটা পুরাসম্পদ।