চণ্ডীবাবু হাসতে-হাসতে বললেন,–এখনও জানাননি। আমাকেও সতর্ক করে দিয়েছেন। তবে তিনি আপনাকে কথাটা জানাতে বলেছেন।
কিছুক্ষণ পরে ডাইনে-বাঁয়ে সংকীর্ণ রাস্তায় ঘুরতে-ঘুরতে অবশেষে আমরা চণ্ডীবাবুর বাড়ি পৌঁছুলুম। তখন দিনের বোদ প্রায় মুছে গেছে। ঠান্ডাটা বাড়তে শুরু করেছে।
কার্তিক আমাদের ঘরের তালা খুলে দিয়ে বলল,–আপনারা বসুন স্যার। আমি ঠাকুরমশাইকে কফি করতে বলি। আজ ঠান্ডাটা যেন কালকের চেয়ে বেড়ে গেছে।
চণ্ডীবাবু গাড়ি গ্যারেজে রেখে এতক্ষণে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। তারপর সোফায় বসে বললেন,–মিস্টার হালদারের খোঁজে আমি কারুকে পাঠাব নাকি?
কর্নেল বললেন,–থাক। উনি একজন অভিজ্ঞ প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। ওঁর কথা ভাববেন না। আপনাকে এবার একটা কথা জিগ্যেস করি। চাটুজ্যেবাড়ির উত্তরে যে নতুন বাড়িটা হচ্ছে, সেখান থেকে কিছুটা দূরে একটা খুব পুরোনো বাড়ি আছে দেখেছি। ওই বাড়িটা কার?
চণ্ডীবাবু বললেন,–বুঝেছি। ওই বাড়িটার মালিক ছিলেন নলিনী বাঁড়ুজ্যে নামের এক ভদ্রলোক। তিনি দুর্গাপুরে ছেলের কাছে চলে যান। যাওয়ার আগে বাড়িটা দেখাশোনার জন্য হরিপদ হাজরা নামে একটা লোকের ওপর দায়িত্ব দিয়ে যান। হরিপদর বাড়ি পাশেই। গতবছর মণি রায়চৌধুরী তার দলের অফিস করবে বলে বাড়িটা দখল করেছিল। খবর পেয়ে নলিনীবাবু তার নামে মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় তার জয় হয়েছিল। কিন্তু মণি হাইকোর্টে আপিল করেছে। হাইকোর্ট ইনজাংশান দিয়ে বলেছে, যতদিন না মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়, ততদিন ওই বাড়িতে কেউ বাস করতে পারবে না। আসলে নলিনীবাবুর বাড়িটা তার এক জেঠাকমশাইয়ের তৈরি। তাঁর কাছেই নলিনীবাবু ছোটবেলা থেকে থাকতেন। সমস্যা হল জেঠাকমশাই উইল করে তাকে বাড়িটা দিয়ে যাননি।
এই সময় ঠাকুরমশাই প্রকাণ্ড ট্রে এনে সেন্টার টেবিলে রাখলেন। দেখলুম কফির সঙ্গে দু-প্লেট পকৌড়া আছে। অতএব শীত সন্ধ্যায় আরাম করে কফি পান শুরু হল। চণ্ডীবাবু কী বলতে যাচ্ছিলেন, এমনসময় কার্তিক এসে খবর দিল, কর্তামশাই আপনার টেলিফোন এসেছে।
চণ্ডীবাবু কফির কাপ-প্লেট হাতে নিয়েই বেরিয়ে গেলেন।
এই সময়েই কর্নেলকে জিগ্যেস করলুম,চাটুজ্যেবাড়ির পাঁচিলের নীচে জবাগাছের গোড়া খুঁড়লে সত্যিই কি সোনার মোহর ভরতি ঘড়া পাওয়া যাবে?
কর্নেল বললেন,–পাওয়া গেলে অনেক আগেই অন্তত শরদিন্দুবাবু জায়গাটা খুঁড়ে বের করে ফেলতেন। অবশ্য শচীনবাবুরাও তার ভাগ পেতেন।
বললুম,–আপনি ওই সংকেতের জট যেভাবে খুলেছেন, সেই ভাবেই কি অন্য কেউ খুলতে পারেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–একজন অন্তত পেরেছিল। সে হল মহীন চাটুজ্যে। কারণ, তুমি সচক্ষে দেখেছ পাঁচিলের নীচের দিকটা সিঁদুর মাখানো আর নুড়ি পড়ে আছে।
অবাক হয়ে বললুম,–কিন্তু মহীনবাবুর হঠাৎ অন্তর্ধান একটা রহস্যের সৃষ্টি করেছে।
কর্নেল বললেন,–জয়ন্ত তুমি বোঝে সবই, তবে বড্ড দেরিতে। তুমি এখনও বুঝতে পারছ না, ওই পাহাড়ি নদীর নুড়িগুলো কে নিয়ে এসেছিল, এবং কে তা রাতবিরেতে বাড়িতে ছুঁড়ে বাড়ির লোকেদের ভয় দেখিয়েছে। এমনকী, ছাদে উঠেও দাপাদাপি করেছে।
এবার চমকে উঠে বললুম,–কী কাণ্ড! তাহলে কি মহীনবাবুই তার বাড়ির লোকেদের ভূতের ভয় দেখাতেন?
কর্নেল বললেন,–আবার কে? তবে এ-ব্যাপারে তাকে সাহায্য করত কানা ভুতু আর গুপে সিংঘি। তারা শচীনবাবুর কাছে আড্ডা দিতে এসে আসলে মহীনবাবুর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখত। অবশ্য এটা আমার অঙ্ক।
–হঠাৎ আমার চমক জাগল। বললুম,–কর্নেল সেই পুরোনো বাড়িতে যে সাধুবাবাকে দেখলুম, তিনিই মহীনবাবু নন তো?
কর্নেল বলেন, কিছুক্ষণ পরে আবার আমাদের বেরুতে হবে। মনে-মনে তৈরি থাকো। যাওয়ার সময় থানার ওসি মিস্টার সেন এবং পুলিশ ফোর্স আমাদের সঙ্গে থাকবে।
এই সময় কার্তিক এসে বলল,–কর্তামশাই কর্নেলসাহেবকে ডাকছেন। আপনি এখনই আমার সঙ্গে আসুন।
কর্নেল তখনই দ্রুত উঠে গেলেন। আমি চুপচাপ বসে কর্নেলের অঙ্কটাকে নিজের বুদ্ধিমতো কষে দেখার চেষ্টা করলুম। কিন্তু অঙ্কটা বড্ড জটিল। বিশেষ করে মহীনবাবু কেনই বা তাদের পূর্বপুরুষের গুপ্তধনের খবর ওই বজ্জাত কানা ভুতু আর গুপে সিংঘিকে দিতে চাইবেন। তা ছাড়া তিনি তো সাধু-সন্ন্যাসীদের মতো মানুষ। সোনার মোহরে তার লোভ থাকার কথা নয়।
অঙ্কটা কষতে গিয়ে হাল ছেড়ে দিলুম। দেখা যাক কর্নেলের রাতের অভিযান কোথায় গিয়ে পৌঁছায়।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ফিরে এলেন। তারপর বললেন,–ওসি প্রণবেশ সেন চণ্ডীবাবুকে ডেকে আমার খবর জিগ্যেস করছিলেন।
বললুম,–তাহলে আপনার প্ল্যান মিস্টার সেনকে জানিয়ে এলেন?’
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। আমার অঙ্ক যদি ঠিক হয়, তাহলে সব রহস্য ফাঁস করে দিয়ে রাত দশটার মধ্যেই ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়তে পারব।
জিগ্যেস করলুম,–চণ্ডীবাবু আমাদের সঙ্গী হবেন তো?
কর্নেল বললেন,–হবেন। তবে উনি আমাদের আগেই বেরিয়ে যাবেন। যেখানে আমরা হানা … দেব, উনি তার কাছাকাছি জায়গায় উপস্থিত থাকবেন। যাই হোক, এখন ওসব কথা নয়।
বলে কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে ধ্যানস্থ হলেন।
সময় কাটতে চাইছিল না। কিন্তু আটটা বাজতে চলল, তখনও হালদারমশাইয়ের পাত্তা নেই। আমি কর্নেলকে কথাটা বললুম। কিন্তু তিনি কোনও জবাব দিলেন না।