কর্নেল বললেন,–আশ্চর্য! এখানে দেখছি জবা গাছটার গোড়ায় ঘাসের ভেতরে কয়েকটা নুড়ি-পাথর পড়ে আছে। কিন্তু তার চেয়েও আশ্চর্য, দেওয়ালের নীচে এই অংশে সিঁদুরের ছোপ।
বাসন্তী দেবী বলে উঠলেন,–মহীনের কীর্তি। প্রায়ই দেখতুম, ওখানে বসে সে করজোড়ে যেন ধ্যান করছে।
কর্নেল বললেন,–এই নুড়িগুলো যেমন আছে, তেমনি পড়ে থাক। আর আপনাদের একটা কথা বলতে চাই। মহীনবাবুকে কেউ খুন করেনি। তিনি কোথাও আছেন। হয়তো তাকে আটকে রাখা হয়েছে, অথবা তিনি নিজেই আত্মগোপন করেছেন।
বাসন্তী দেবী এবং শচীনবাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
.
আট
বাসন্তী দেবী এবং শচীনবাবুকে আর কথা বলার সুযোগ না-দিয়ে কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, –চলো জয়ন্ত, আমাদের এখানকার কাজ শেষ। শচীনবাবু, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন। আশা করি ভূতের উপদ্রব আর হবে না।
রাস্তায় বেরিয়ে গিয়ে কর্নেল চাটুজ্যেবাড়ির উত্তরের পাঁচিলের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলেন। তিনি আমার কোনও প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। এই রাস্তাটা সংকীর্ণ এবং ইটের গুড়োয় ভরতি। দেখলুম বাঁ-ধারে একটা নতুন বাড়ি উঠছে। সেখানে কেউ নেই। কর্নেল আরও একটু এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ একটা প্রকাণ্ড নিমগাছের আড়ালে আমাকে টেনে নিয়ে দাঁড় করালেন। নিমগাছটা চাটুজ্যেবাড়ির দেওয়ালের উত্তর-পূর্ব কোণে। সামনে খানিকটা পোড়ো জমি, তার ওপাশে পুরোনো একটা বাড়ি। সেই বাড়ির দিকে তাকিয়ে কর্নেল চাপাস্বরে বললেন,–একটু লক্ষ রাখো। একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পাবে।
কর্নেলের কথা শুনে ভেবেই পেলুম না কখন উনি অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পেলেন। এবং সেই ব্যাপারটা আবার যে ঘটবে, তাই বা কী করে বুঝলেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। আমি কর্নেলের মতো হাঁটু গেড়ে বসে তাকিয়ে রইলুম। তারপর দেখলুম একটা লোক ওই বাড়িটা থেকে কয়েক পা বেরিয়ে এসে চাটুজ্যেবাড়ির দিকে তাকিয়ে কী দেখল। তারপর আবার সেই বাড়িতে গিয়ে ঢুকল। দিনের আলো কমে এসেছে, তবু লোকটার চেহারা দেখেই বুঝতে পারলুম সে একজন সাধুবাবা। তার মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, মুখে একরাশ কাঁচা-পাকা গোঁফ-দাড়ি। গায়ে একটা গেরুয়া হাফ-হাতা ফতুয়া। পরনে খাটো গেরুয়া লুঙ্গি। লোকটার হাবভাব দেখে মনে হল সম্ভবত সে একজন পাগল। তা না-হলে আমরা তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই অন্তত বার তিনেক ওইভাবে বাড়িটা থেকে বেরুল, আবার যেন কিছু দেখে হন্তদন্ত হয়ে সেই বাড়িতে গিয়ে ঢুকল। তারপর আরও কিছুক্ষণ আমরা বসে রইলুম, কিন্তু সে আর বেরুল না।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাকে চুপ করে থাকার ইঙ্গিত করলেন। তারপর যেদিক থেকে এসেছিলুম, সেদিকেই দুজনে ফিরে চললুম। চাটুজ্যেবাড়ির সামনের রাস্তায় পৌঁছে এবার ডানদিক ঘুরে দুজনে এগিয়ে চললুম। এই পথেই রিকশাওয়ালা আমাদের নিয়ে এসেছিল। কিন্তু পাড়াটা একেবারেই নিঝুম এবং রাস্তাঘাটে কোনও লোক নেই। কর্নেল রিকশাওয়ালার মতো শর্টকাট না-করে সোজা এগিয়ে যাচ্ছিলেন। রাস্তাটায় কবে পিচ দেওয়া হয়েছিল। এখন এখানে-ওখানে পিচ উঠে গেছে। বললুম,–আমরা এ-পথে গিয়ে কোথায় পৌঁছুব?
কর্নেল বললেন,–যেখানে তোক পৌঁছুব, চিন্তু করো না। এবার আমাকে প্রশ্ন করো।
জিগ্যেস করলুম,–ওই সাধুবাবা সম্পর্কে?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ।
বললুম,–আপনি কী করে জানলেন, ওই বাড়িতে এক সাধুবাবা থাকে?
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–আজ সকালের দিকে চাটুজ্যেবাড়ির পাঁচিলে যখন ভূতের মুখোশ পরা লোকটার দিকে ছুটে গিয়েছিলুম। তখনই আমার চোখে পড়েছিল পোড়ো জমিটার ওখানে ওই সাধুবাবা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তখন সঙ্গে চণ্ডীবাবু ছিলেন। তার সামনে ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিলুম।
অবাক হয়ে বললুম,–সর্বনাশ, আপনি চণ্ডীবাবুকেও সন্দেহ করেন নাকি?
কর্নেল বললেন, তুমি তো জানোনা, খেলতে নেমে কখনও আমি নিজের হাতের তাস কাউকেই দেখাই না। এমনকি তোমাকেও না।
এতক্ষণে চোখে পড়ল কিছুটা দূরে রাস্তার একটা বাঁক থেকে একটা গাড়ি এদিকে আসছে। কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে বললেন,–ওই দ্যাখো চণ্ডীবাবুর নাম করতে-করতেই উনি আমাদের খোঁজে ছুটে আসছেন।
গাড়িটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। চণ্ডীবাবু নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন,–কর্নেলসাহেবের খোঁজে বেরিয়েছিলুম। একমিনিট, আমি গাড়িটা ঘুরিয়ে নিই।
বাঁদিকে একটা গলিরাস্তা ছিল। তিনি সেখান দিয়ে গাড়িটা ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর কর্নেল সামনের সিটে এবং আমি ব্যাক সিটে বসলুম। কর্নেল বললেন, আপনি ছিলেন না, অগত্যা আমি আর জয়ন্ত বেরিয়ে পড়েছিলুম। আমাদের হালদারমশাই কি ফিরেছেন?
চণ্ডীবাবু বললেন, না। তার জন্য আমি উদ্বেগ বোধ করছি। কানা ভুতু আর গুপে পুলিশের হাজতে। এতে তাদের বন্ধুরা নিশ্চয়ই রাগে ফুঁসছে। দৈবাৎ তাদের পাল্লায় পড়লে মিস্টার হালদার আক্রান্ত হতে পারেন।
কর্নেল বললেন, আপনি কি ওসি মিস্টার সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন?
চণ্ডীবাবু বললেন,–হ্যাঁ। ওরা বাধ্য হয়ে স্বীকার করেছে মণির কুকুরটাকে ওরা স্বপ্নে বাবা মহাদেবের আদেশ পেয়ে, তার সামনে বলি দিয়েছে। তারপর ধড় আর মুণ্ডু গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে।
কর্নেল জিগ্যেস করলেন,–ওসি কি মণিকে একথা জানিয়েছেন?