রিকশাওয়ালা হাসবার চেষ্টা করে বলল,–আজ্ঞে না স্যার। আমি কারুর সাতে-পাঁচে থাকি না, আমাকে কে খুন করবে?
কর্নেল বললেন,–চাটুজ্যেবাড়ির মহীনবাবুও তো শুনেছি কোনও সাতে-পাঁচে থাকতেন না। সাধু-সন্ন্যাসীর মতো জীবন কাটাতেন। তিনি খুন হলেন কেন?
রিকশাওয়ালা এবার ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরে বলল,–সাহেবরা কি ওনাদের আত্মীয়?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। শচীনমাস্টার সম্পর্কে আমার ভাইপো হন।
রিকশাওয়ালা এবার বাঁ-দিকে মোড় নিল। দু-ধারেই ইটের বাড়ি। মাঝে-মাঝে মাটির বাড়ি। এটা গলি রাস্তা। লোক চলাচল খুব কম। রিকশাওলা আপন মনে বলল,–এ-সংসারে মানুষ চেনা বড় কঠিন। ভালোমানুষ কি কখনও খুন হয়?
কর্নেল বললেন,–তাহলে কি তুমি বলতে চাও, মহীনবাবু ভালোমানুষ ছিলেন না?
রিকশাওয়ালা অদ্ভুত শব্দে হাসল। বলল,–ভালোমানুষ হলে কি সে বজ্জাতদের সঙ্গে গাঁজার কলকে টানে?
–কোন বজ্জাতের সঙ্গে উনি গাঁজা খেতেন?
–আপনি চিনবেন না স্যার। দুই বজ্জাতকেই আজ পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। মণি রায়চৌধুরী দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষেছিলেন।
কর্নেল হঠাৎ চুপ করে গেলেন। আমার মনে হল উনি রিকশাওয়ালাকে মনের কথা খুলে বলার সুযোগ দিচ্ছেন। একটু পরে বুঝলুম ঠিক তাই। লোকটা আপনমনে কথা বলতে-বলতে প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে।
–অমন একখানা তাগড়াই কালো রঙের বিলিতি কুকুর ছিল মণিবাবুর। তাকে চুরি করে কোথায় বেচে দিয়ে এসেছে। মণিবাবু কি সহজে ছাড়বেন? এদিকে থানার বড়বাবুও উঁদে দারোগা। কত দাগি ওঁর ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে! কানাভুতু আর গুপে সিংঘিকে কাপড়ে-চোপড়ে করে ছাড়বেন।
অলিগলি ঘুরতে-ঘুরতে রিকশাওয়ালা শর্টকাটেই আমাদের চাটুজ্যেবাড়ির সামনে পৌঁছে দিল।
কর্নেল তার হাতে একটা দশ টাকার নোট গুঁজে দিলেন। সে বলল, আমার কাছে খুচরো তো নেই স্যার।
কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। তোমাকে পুরো টাকাটাই বকশিশ দিলুম।
সে সেলাম করে চলে গেল। বুঝতে পারলুম বিকেল হয়ে আসছে, আলো কমে গেছে। সম্ভবত পাগলা বিনোদের জ্যান্ত মড়ার ভয়েই লোকটা যেন পালিয়ে গেল।
কর্নেল দরজার কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গেল। দেখলুম শচীনবাবু তার গাবদা ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখে যেন অবাক হলেন। বললেন, আমি এখনই আপনাদের কাছে যাচ্ছিলুম। ভেতরে আসুন স্যার। আমরা ভেতরে ঢুকলে তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন,–ভুতু আর গোপেনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে শুনলুম। তবে আমাদের কেসের ব্যাপারে নয়। ওরা নাকি মণি রায়চৌধুরীর অ্যালসেশিয়ানটাকে চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছে।
কর্নেল বললেন, আপনার পিসিমা কী করছেন?
–পিসিমা বাবার পা টিপে দিচ্ছেন।
–ঠিক আছে। চলুন আমরা একবার মন্দিরের দিকে যাই।
শচীনবাবু খোঁড়াতে-খোঁড়াতে এগিয়ে গিয়ে মন্দিরের দিকের দরজা খুলে দিলেন। একবার পিছু ফিরে দেখলুম বাসন্তী দেবী বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন।
মন্দিরের সামনে গিয়ে কর্নেল বললেন,–আচ্ছা শচীনবাবু, আপনাদের এই বাড়ির কোথাও কি কোনও বিশাল গাছ ছিল, এমন কথা শুনেছেন?
আমাদের পেছন দিকে খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে বাসন্তী দেবী বলে উঠলেন,–তেঁতুলগাছ? ছোটবেলায় ঠাকমার কাছে শুনতুম, কোন যুগে নাকি কামরূপ কামাক্ষা থেকে এক ডাকিনি একটা তেঁতুলগাছে চড়ে গঙ্গাদর্শনে যাচ্ছিলেন। এ-বাড়ির সীমানায় যেই সে এসেছে, অমনি নাকি সূর্য উঠেছিল। দিনের বেলায় নাকি ডাকিনিদের বাহন গাছ আর উড়তে পারে না। সূর্যের ছটা দেখলেই সেইখানে শিকড় গেঁথে দাঁড়িয়ে যায়।
শচীনবাবু বললেন,–হা-হা মনে পড়েছে। সেই তেঁতুল না কি খাওয়া যেত না। ভাঙলেই রক্ত বেরুত। তবে সেসব নেহাতই বাজে গপ্পো।
ততক্ষণে কর্নেল পিঠের কিট ব্যাগ থেকে একটা গোল ফিতের কৌটো বের করে একদিকটা টেনে আমাকে বললেন,–জয়ন্ত, এই ডগাটা ধরো। মন্দিরের ঠিক মাঝামাঝি বারান্দার গায়ে এটা ধরে থাকো। আঠারো ইঞ্চিতে এক হাত, অতএব পাঁচ বা দশ হাতের হিসেব করতে অসুবিধে নেই।
বলে তিনি পকেট থেকে ভাঁজ করা সেই কাগজটা শচীনবাবুকে দিলেন। শচীনবাবু খুলে দেখে বললেন,–এটা সেই পুরোনো দলিল দেখছি।
এরপর কর্নেলের কাণ্ড দেখে শচীনবাবু আর তার পিসিমা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কর্নেল তারপর সামনে এক জায়গায় থামলেন। তারপর বাঁ-দিকে এগিয়ে গেলেন এবং আমাকে বললেন,–এবার ফিতেটা তুমি ওই দাগ দেওয়া জায়গায় ধরে রাখো। তারপর তার যে মাপজোক শুরু হল, তা চণ্ডীবাবুর ঘরে বসে কর্নেল একটা প্যাডের পাতায় লিখে ছিঁড়ে ফেলেছেন। তাঁর মাপজোক শেষ হল যেখানে, সেখানে চাটুজ্যেবাড়ির পাঁচিল। পাঁচিলের নীচে একটা ইটের টুকরো কুড়িয়ে তিনি দাগ দিলেন।
শচীনবাবু বললেন,–কিছুই তো বুঝতে পারছি না কর্নেলসাহেব।
কর্নেল বললেন–চলুন। বাড়ির ভেতরে এই পাঁচিলের নীচের দিকটা একবার পরীক্ষা করব। জয়ন্ত, তুমি ওই চিহ্নের সোজাসুজি দাঁড়িয়ে পাঁচিলের ওপর একটা হাত তুলে রাখবে। তাহলে আমি বুঝতে পারব পাঁচিলের ভেতর দিকে ওপাশে: চিহ্নটা কোথায় পড়বে।
আমি হাত তুলে দাঁড়িয়ে রইলুম। কর্নেল ভে… ণেলেন। তার সঙ্গে শচীনবাবু এবং তাঁর পিসিমাও গেলেন। একটু পরে কর্নেল ডাকলেন,–চলে এসো জয়ন্ত। আমার কাজ শেষ।
ভেতরে গিয়ে দেখলুম, তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে একটা জবাফুলের ঝোঁপ। রক্তজবায় ঝোঁপটা লাল হয়ে আছে।