হালদারমশাই গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন। এবার বলে উঠলেন,–কী কাণ্ড! অ্যালসেশিয়ান কুকুরটাকে তাহলে ওই একচক্ষু ভুতু আর গোপেন মন্দিরের সামনে বলি দিয়েছিল। ঠিক কইসি কি না কন কর্নেলসাহেব।
কর্নেল সায় দিয়ে বলেছিলেন,–আপনি ঠিক ধরেছেন হালদারমশাই। রাত্তিরবেলা পথের কুকুর ধরা কঠিন কাজ। তার চেয়ে পোষা কুকুর কোলে তুলে নিয়ে এসে ইচ্ছেমতো তাকে ব্যবহার করা যায়। বেচারা জানত না তাকে ওরা বলি দেবে।
আমি বলেছিলুম,–কুকুর বলি দিয়ে রক্ত ছড়ানোর উদ্দেশ্য কী? কুকুরের বডিটা নিশ্চয়ই গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে। ফরাক্কার ফিডার ক্যানেলের জলে এখন গঙ্গা বারোমাসই কানায়-কানায় ভরা। তোতও তীব্র। কাজেই কুকুরের লাশ এতক্ষণ বহুদূরে পৌঁছে গেছে। কোথাও আটকে গেলে আলাদা কথা।
হালদারমশাই বলেছিলেন,–এতক্ষণ লাশের কিস্যু নাই। শকুনের পাল কুত্তাটা বেবাক খাইয়া ফেলসে।
কেন দুই স্যাঙাত মিলে তাদের গার্জেনের পোষা কুকুর ওখানে বলি দিলো, সেই প্রশ্নের উত্তর আমি কর্নেলের মুখ থেকে আদায় করতে পারিনি। চণ্ডীবাবু বা হালদারমশাইও কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তবে আমার মনে হয়েছিল শচীনবাবুর ছোটকাকা মহীনবাবুকে নিশ্চয়ই ওরা কোথাও আটকে রেখে গুপ্তধনের খোঁজ পেতে চেয়েছিল।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর কর্নেল আমাকে ভাত-ঘুমের সুযোগ দেননি।
ওদিকে হালদারমশাই এবার আরও উত্তেজিত হয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তখন বেলা প্রায় আড়াইটে বাজে। কর্নেল আমাকে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে বললেন। তারপর পকেট থেকে সেই অং বং লেখা কাগজটা বের করলেন। তার প্রকাণ্ড ব্যাগটা থেকে একটা প্যাড বের করে বললেন,–এসো, এই সঙ্কেতগুলোর কোনও সমাধান বের করা যায় কি না দেখি। তোমার মাথায় কিছু এলে আমাকে বলবে। জয়ন্ত এটা কোনও হাসির ব্যাপার নয় কিন্তু।
আসলে আমি তার গাম্ভীর্য দেখে হেসে ফেলেছিলুম। প্যাডটা সেন্টার টেবিলে রেখে হাতে একটা ডট পেন নিলেন। তারপর সেই কাগজটা খুলে পাশে রাখলেন।
কর্নেল বললেন,–ধরা যাক মং-টা মন্দির। কারণ অম্লং থেকে শুরু করলে কিছু বোঝা যাবে না। মং-কে যদি মন্দির ধরি, তাহলে পাঁচ হাত এগোতে হবে মন্দিরের উলটো দিকে। সেটা পেছনের দিক হতে পারে, আবার সামনের দিকও হতে পারে। ধরা যাক মন্দিরটা শচীনবাবুদের শিবমন্দির। মন্দিরের পেছনে কিন্তু পাঁচ হাত জায়গা নেই। অতএব পুকুরের দিকে পাঁচ হাত এগিয়ে যাওয়া যাক। তারপর বাঁ-দিকে দশ হাত এগিয়ে গেলুম-কেমন। তারপর পাঁচ হাত পুকুরের দিকে আবার এগুলুম। এরপর সেখান থেকে ডান দিকে দশ হাত এগুনো যাক। সেখানে আমরা পাচ্ছি অম্লং-কে।
বললুম,–আপনি হং মানে হস্ত ধরছেন?
কর্নেল বললেন,–তীরচিহ্ন দেখে তাই মনে হচ্ছে।
বললুম,–বেশ তো, এবার অম্লং-টা কী?
কর্নেল টাকে হাতে বুলিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকার পর বললেন,–অম্লং বলতেই একটা স্বাদের কথা আসে। অর্থাৎ টক। এখন টক তো কোনও বস্তু হতে পারে না। একটু ভেবে বলো তো জয়ন্ত, পাড়াগাঁয়ে টক বলতে মনে কী ভেসে ওঠে?
বললুম,–টমাটো।
কর্নেল হাসতে-হাসতে বললেন,–ধরা যাক দলিলটা পাঁচশো বছরের নয়, ওটা হয়তো বাড়িয়ে বলা হচ্ছে, কিন্তু টমাটো এদেশে এনেছে পর্তুগিজরা। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, টমাটো তো স্থায়ী কিছু নয়। চাটুজ্যে বাড়িতে টমাটো চাষ কল্পনা করা যায় না।
আমি বলে উঠলুম,–তাহলে অম্লটা কোনও তেঁতুলগাছ নয় তো?
কর্নেল হেসে উঠলেন,–তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ, কিন্তু পাঁচশো কেন দুশো-তিনশো বছরও। কোনও তেঁতুলগাছের আয়ু হতে পারে না।
বলে কর্নেল প্যাডের কাগজটা টেনে নিলেন, এবং মূল কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে ঢোকালেন। প্যাডের কাগজটাও ছিঁড়ে নিলেন। কারণ, এতে ব্যাপারটার ব্যাখ্যা লেখা হয়েছে। দ্বিতীয় কাগজটা এনে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে অ্যাশট্রেতে ঢোকালেন। তারপর তার ওপর নিভে আসা চুরুটটা ঘষটে অ্যাশট্রেতে ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর বললেন,–উঠে পড়ো, বেরুনো যাক।
বললুম,–চণ্ডীবাবুকে সঙ্গে নেবেন না?
কর্নেল বললেন,–না। উনি সম্ভবত তোমার মতো ভাত-ঘুম দিচ্ছেন।
দুজন পোশাক বদলে নিলুম। কর্নেলের নির্দেশে প্যান্টের পকেটে আমার অস্ত্রটা ভরে নিলুম। কর্নেল ওপাশের দরজা খুলে বেল টিপে কার্তিককে ডাকলেন। তখনই কার্তিক এসে হাজির হল। কর্নেল জিগ্যেস করলেন,–তোমার কর্তামশাই কি ঘুমোচ্ছেন?
কার্তিক বলল,–আজ্ঞে না। উনি আধঘণ্টা আগে বেরিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, আপনারা কোথাও যেতে চাইলে আমি যেন ড্রাইভারকে ডেকে দিই।
কর্নেল বললেন,–না, আমরাও তোমার কর্তামশাইয়ের মতো পায়ে হেঁটে বেরুব। তুমি দরজায় তালা লাগিয়ে রাখো।
গেট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে কর্নেল দক্ষিণ দিকে হাঁটতে থাকলেন। সেই সময় সামনের দিক থেকে একটা খালি সাইকেলরিকশা আসছিল। রিকশাওয়ালা নিজে থেকেই থেমে গিয়ে বলল,–সাহেবরা যাবেন নাকি?
কর্নেল ঘড়ি দেখে নিয়ে চাপাস্বরে বললেন,–শীতের রোদ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। রিকশা করেই যাওয়া যাক।
রিকশায় চেপে তিনি বললেন, আমরা যাব চাটুজ্যেমশাইদের বাড়ি।
রিকশাওয়ালা মুখ ঘুরিয়ে সন্দিগ্ধভাবে বলল,–যে বাড়িতে মানুষ খুন হয়েছে—
তার কথার ওপর কর্নেল বললেন,–হ্যাঁ। তবে তোমার ভয় নেই, তুমি খুন হবে না।