আমি বলতে যাচ্ছিম, কর্নেল সেই তিনটে ঢিল আজ কুড়িয়ে পেয়েছেন। কিন্তু কর্নেল যেন কোনও মন্ত্রবলে সেটা টের পেয়েই একবার আমার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে নিয়ে তারপর বললেন,–হ্যাঁ আপনার পিসিমার পক্ষে ভূতুড়ে ঢিল দেখে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তারপর কি আপনার কাকা এ-ব্যাপারে কোনও হইচই বাধিয়েছিলেন?
শচীনবাবু বললেন,–না, আপনাকে তো আগেই বলেছি, কাকা সন্ন্যাসীটাইপ মানুষ। খামখেয়ালি। আমরাই বলতুম, কাকার মাথায় ছিট আছে। তা ছাড়া একটু মনভোলা স্বভাবের মানুষও ছিলেন।
কর্নেল বললেন,–এবার একটা কথা। আপনার কাকা কি কখনও তীর্থ করতে গেছেন?
শচীনবাবু বললেন, হ্যাঁ। কাকা বছরে অন্তত বার দুই-তিনেক তীর্থ করতে যেতেন। প্রতিবারই আমাদের ভয় হত, উনি হয়তো আর বাড়ি ফিরবেন না। কোনও সাধুর কাছে দীক্ষা নিয়ে হিমালয়ে গিয়ে বাস করবেন। কিন্তু কাকা ফিরে আসতেন, তারপর তীর্থের গল্প শোনাতেন।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন,–ঠিক আছে। আপনি বাড়ি ফিরে গিয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখুন। আমার কথা মতো ওই কাগজের একটা কপি ভুতু আর গোপেনকে দেবেন কি না। এটা কিন্তু খুব জরুরি।
শচীনবাবু উদ্বিগ্ন মুখে বেরিয়ে গেলেন। তার হাতে সেই মোটা লাঠির মতো ছড়িটা ছিল। সেটাতে ভর দিয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতেই বেরিয়ে গেলেন।
হালদারমশাই উঠে গিয়ে দরজায় উঁকি মেরে শচীনবাবুর প্রস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ফিরে এলেন। তারপর উত্তেজিতভাবে বললেন,আমি এবার শচীনবাবুরে সুযোগ পাইলেই ফলো করুম। ভদ্রলোকেরে আমার আর সরল মানুষ ঠেকত্যাসে না।
জিগ্যেস করলুম,–কেন বলুন তো?
হালদারমশাই বললেন,–সেই একচক্ষু ভুতু আর তার লগে গোপেনেরে আমি কথা কইতে দেখসি। একচক্ষু বজ্জাতটা শচীনবাবুগো বাড়ির পাশ দিয়া বাহির হইয়া হনহন কইর্যা আমবাগানের ভেতর দিয়া যাইত্যাসিল। এখন মনে হইতাসে বাড়ির পেছন দিকে কোথাও ওই একচক্ষু লোকটা শচীনবাবুর লগে গোপনে পরামর্শ করত্যাসিল। অগো তিনজনের মইধ্যে যোগাযোগ আছে। অরা তিনজনে একখান ত্রিভুজ।
কর্নেল সহাস্যে বললেন, আপনার এই ত্রিভুজতত্ত্ব উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আমি বললুম,–এযাবৎকালে গুপ্তধন নিয়ে কয়েক ডজন রহস্যের সমাধান কর্নেল করেছেন। গুপ্তধন কোথাও পাওয়া যায়নি, তা ঠিক। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে সত্যি-সত্যি চাটুজ্যেবাড়ির কোথাও-না-কোথাও সোনার মোহর ভরতি একটা ঘড়া পোঁতা আছে। ওই কাগজটার মধ্যেই তার সংকেত আছে।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–তোমাকে একটা কপি দেব, তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো গুপ্তধনের জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারো কি না।
চণ্ডীবাবু এতক্ষণে ঘরে ঢুকলেন। হাসতে-হাসতে বললেন,–শচীনের মুখ-চোখ দেখে মনে হল ওকে আপনি ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। আমাকে খুলে কিছু বলল না, শুধু গোমড়া মুখে একটা কথা বলল, ওবেলা সে সন্ধ্যার দিকে কর্নেলসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসবে।
কর্নেল বললেন,–আচ্ছা মিস্টার রায়চৌধুরী, শচীনের মুখে শুনলুম, আপনাদের এক জ্ঞাতি মণীন্দ্র রায়চৌধুরী
চণ্ডীবাবু কর্নেলের কথার ওপর বললেন,–শচীন কি মণি সম্পর্কে কিছু বলছিল?
কর্নেল বললেন,–তিনি নাকি একটা রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা। আপনাদের সঙ্গে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। একচোখা ভুতু আর গোপেন নাকি তার চ্যালা।
চণ্ডীবাবু বিকৃতমুখে বললেন,–মণি রায়চৌধুরি বংশের কলঙ্ক। আমার ঠাকুরদার বৈমাত্রেয় ভাইয়ের পৌত্র সে। কাজেই রক্তের সম্পর্ক আছে তা বলা যায়ই। কিন্তু তার রাজনৈতিক দল তার কাজকর্মে খুব অসন্তুষ্ট। তা ছাড়া খুলেই বলি, আমি রাজনীতি করি না, কিন্তু মণি এক-একসময় এমন সব সাংঘাতিক কাজ করে যে তার মা গোপনে এসে আমার সাহায্য চায়। আমার মা বেঁচে নেই, কিন্তু মণির মাকে আমি নিজের মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করি।
এই সময় কার্তিক দরজায় উঁকি মেরে বলল,–ঠাকুরমশাই বাজার থেকে ফিরে বললেন, ভুতো আর গোপেনকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে।
.
সাত
ভুতু আর গোপেনকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে শুনেই হালদারমশাই খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন, –আমি ঠিক দেখসিলাম, ওরা দুইজনে কোনও প্ল্যান আঁটতাসে। পুলিশের সোর্স থাকে। তা তো আপনারা জানেন। এই সোর্সই ওগো ধরাইয়া দিসে।
কিন্তু খবরটা শুনে চণ্ডীবাবু তখনই থানায় ফোন করতে গিয়েছিলেন। কর্নেলকে বলেছিলুম,–এবার থানার ওসি ওদের পেটের কথা সব বের করে নেবেন। মাঝখান থেকে আপনি নিজের কৃতিত্ব দেখানোর সুযোগ হারালেন।
কর্নেল মিটিমিটি হসে বলেছিলেন,জয়ন্ত, তোমাকে বরাবর বলে আসছি ন্যায়শাস্ত্রের অপভাষ তত্ত্বের কথা। ইংরেজিতে যাকে বলে হোয়াট অ্যাপিয়ার্স ইজ নট রিয়েল।
কিছুক্ষণ পরে চণ্ডীবাবু ফিরে এসে হাসতে-হাসতে বলেছিলেন,–মণির এক আজব কীর্তি। সে-ই পুলিশের কাছে তার দুই বিশ্বস্ত চ্যালার নামে অভিযোগ করেছিল, তারা তার প্রিয় অ্যালসেশিয়ান কুকুরটাকে চুরি করে না কি বেচে দিয়েছে। চুরি করার সাক্ষীও আছে। তবে ওসি আমাকে বললেন, কর্নেল সাহেবকে খবরটা দেবেন। কুকুর চুরির ব্যাপারটা নিশ্চয়ই কর্নেলের একটা মোক্ষম কু হয়ে উঠবে।
কর্নেল সহাস্যে বলেছিলেন–কুকুর চুরির কারণটা আপনাদের বোঝা উচিত।
কথাটা শুনেই চণ্ডীবাবু চমকে উঠে বলেছিলেন,–শচীনদের মন্দিরের সামনে হাড়িকাঠের কাছে পড়ে থাকা রক্ত পরীক্ষা করে কলকাতার ফোরেনসিক এক্সপার্টরা রায় দিয়েছেন ওগুলো মানুষের রক্ত নয়।